চাল, ডাল, তেল, আটার মতো নিত্যপণ্যের দাম এখনো চড়া

  • পাবনা ও ফরিদপুরের পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের কেজি উঠেছে ১১০ টাকায়।

  • ১০টি সবজির দাম গত বছরের চেয়ে এখন ১৫-১০০% বেশি।

  • ভোজ্যতেল ও চিনিতে শুল্কছাড়ের প্রভাব পাইকারি বাজারে সামান্য।

চাল, ডাল, তেল ও আটার ব্যয় বেড়েছেছবি: সংগৃহীত

রোজার বাজারে প্রায় প্রতিবছরই দাম বাড়ে চিনির। এবার দাম কমাতে পণ্যটি আমদানিতে কিছুটা শুল্কছাড় দিয়েছে সরকার। কিন্তু তাতে আগের চেয়ে মাত্র ৬৮ পয়সা কম শুল্ক দিয়ে এক কেজি চিনি আমদানি করা যাচ্ছে। ফলে চিনির দাম কমছে না।

রাজধানীতে এখন এক কেজি খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৪০-১৪৫ টাকায়। গত বছর একই সময়ে দর ছিল ১১০-১২০ টাকা। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে এক কেজি চিনি কেনা যেত ৬০ টাকার আশপাশের দামে।

বাজারে চিনির মতো চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, আটা, পেঁয়াজ, মাছ, মাংস ও ডিমের দাম এখনো চড়া। প্রতিবছরের ফেব্রুয়ারিতে এসে শীতকালীন সবজির দাম অনেকটাই কমে যায়। এবার সেখানেও উল্টো চিত্র। সব মিলিয়ে মানুষ স্বস্তিতে নেই।

পেঁয়াজের সরবরাহ কমেছে। দাম বাড়ছে। ভোজ্যতেল, চিনি ও খেজুর আমদানি এখনো কম।

আওয়ামী লীগ গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ঘোষণা করা তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দিয়েছে। নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর মন্ত্রিসভার সদস্যরা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে নানা বক্তব্য ও পদক্ষেপের কথা বলছেন। কিছু কিছু পণ্যে শুল্কছাড় দেওয়া হয়েছে। বাজারে অবশ্য তার বড় কোনো প্রভাব নেই।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব বলছে, খুচরা বাজারে এক মাসে চালের দাম কমেনি, বরং সরু চালের দাম সামান্য বেড়েছে। কমেনি আটা, ময়দা, সয়াবিন ও পাম তেল, ডাল ইত্যাদির দামও। উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে আলুর দাম। ৮০ টাকা থেকে প্রতি কেজির দর নেমেছে ৪০ টাকায়। যদিও গত বছরের এই সময়ে প্রতি কেজি আলু ছিল ২০-২৫ টাকা।

মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি ঢাকা (এমসিসিআই) আয়োজিত মধ্যাহ্নভোজসভায় গতকাল বুধবার বাজার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘বিশ্বের মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে পবিত্র রমজান মাসে ব্যবসায়ীরা উদার হন। কিছুটা চ্যারিটেবল (দানশীল) হন। তবে আমাদের দেশে রমজানকে সুযোগ হিসেবে দেখেন তাঁরা।’ ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তিনি আরও বলেন, ‘আপনাদের প্রতি আমার আন্তরিক অনুরোধ, দয়া করে এবার নমনীয় হন।’

বাজার ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজানোর কথা বলেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, আগামী ১ মার্চ থেকে দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখতে পাবেন। উৎপাদনস্থলের পাশাপাশি বিভিন্ন বাজারে পণ্যের দাম ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জানা যাবে। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির জন্য খুচরা ব্যবসায়ীদের জরিমানা না করে প্রকৃত সমস্যার উৎস খুঁজে সমাধানের চেষ্টা চলছে।

পেঁয়াজের দাম আরও বাড়ছে

বাজারে পেঁয়াজের দাম আরও বাড়ছে। গতকাল ঢাকার কারওয়ান বাজারের আড়তে দেশি মুড়িকাটা পেঁয়াজ ১১০ থেকে ১২০ টাকা কেজি বিক্রি করতে দেখা যায়। পেঁয়াজের উৎপাদনস্থল পাবনা ও ফরিদপুর থেকে প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা জানান, সেখানকার পাইকারি বাজারে প্রতি কেজির দাম ১১০ টাকা হয়ে গেছে।

ঢাকার খুচরা বাজারে এক সপ্তাহ ধরে পেঁয়াজ ১০০-১১০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছিল। পাইকারিতে দাম বেড়ে যাওয়ায় খুচরায় মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। টিসিবি বলছে, এক মাস আগে পেঁয়াজের দাম ছিল ৭০ থেকে ৯০ টাকা। গত বছর এই সময়ে ছিল ৩০ থেকে ৩৮ টাকা।

কারওয়ান বাজারের পাইকারি পেঁয়াজ ব্যবসায়ী বাবুল মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভালো মানের প্রতি কেজি পেঁয়াজ মোকাম থেকে নিয়ে আসতে খরচ হচ্ছে ১১৭ টাকার মতো। আমরা পাইকারিতে ১২০ টাকায় বিক্রি করছি।’ তিনি বলেন, মুড়িকাটা পেঁয়াজের মৌসুম শেষের পথে। আমদানি কম হচ্ছে। তাই বাজার বাড়ছে। সপ্তাহ তিনের মাথায় দেশি হালি (বীজ থেকে উৎপাদিত) পেঁয়াজ উঠতে শুরু করলে দাম কমতে পারে।

বাজারে দরকার পর্যাপ্ত সরবরাহ, যাতে দামের প্রতিযোগিতা হয়। সরবরাহ সংকট থাকলে কোনো উদ্যোগই কাজে আসবে না।
গোলাম রহমান, সভাপতি, ক্যাব

সবজি, মাছ, মাংস ও ডিম

চালের দাম অল্প বাড়লেও তা মূল্যস্ফীতির হারের ওপর বেশি প্রভাব ফেলে। চাল, ডাল ও ভোজ্যতেলের দাম বেশি হলে কষ্টে থাকেন নিম্ন আয়ের মানুষ। তবে মধ্যবিত্তের সংসারে চাপ বেশি ফেলে সবজি, মাছ, মাংস ও ডিমের দাম।

ঢাকার একটি বেসরকারি কলেজের শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর দুই সদস্যের পরিবারে সর্বোচ্চ ১৫ কেজি চাল লাগে। চালের দাম কেজিতে ৫ টাকা বাড়লে তাঁর মাসে ব্যয় বাড়ে ৭৫ টাকা। বিগত এক মাসে এর চেয়ে বেশি ব্যয় বেড়েছে এক কেজি গরুর মাংস কিনতে, ১০০ টাকা। তিনি বলেন, ‘গরুর মাংস না হয় কেনা বাদ দিলাম; ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের দামও তো বাড়ছে। সবজিও কম দামে কেনা যায় না।’

রাজধানীতে সবজির দামের একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। তাদের গতকালের প্রতিবেদনে ১৩টি সবজির দাম উল্লেখ করা হয়েছে। দেখা যায়, গত বছরের একই দিনের তুলনায় ১০টি সবজির দাম এবার বেশি। মূল্যবৃদ্ধির হার ১৫ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত। দুটি সবজির দাম এবার ৭ শতাংশের মতো কম।

যেমন কৃষি বিপণন অধিদপ্তর বলছে, গতকাল শীতের জনপ্রিয় সবজি ফুলকপির দাম ছিল আকারভেদে প্রতিটি ২৫ থেকে ৪০ টাকা, যা গত বছরের একই দিনের তুলনায় ৪৪ শতাংশ বেশি। সস্তা বলে পরিচিত সবজি মুলার দাম ছিল ৩০ থেকে ৪০ টাকা। এ ক্ষেত্রে গত বছরের তুলনায় দাম বেশি ২৭ শতাংশ।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তর রুই, কাতলা, ইলিশ ও পাঙাশ মাছের দামের তুলনামূলক চিত্র দেয়। দেখা যাচ্ছে, গতকাল মাছগুলোর যে দাম ছিল, তা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭ থেকে ৪১ শতাংশ বেশি। তুলনামূলক সস্তা থাকে চাষের মাছ পাঙাশের দাম। সেটির কেজি এখন আকারভেদে ১৮০ থেকে ২৫০ টাকা। ২০২২ সালের সারা দেশের হিসাবে পাঙাশের গড় দাম ছিল ১৩৪ টাকা কেজি।

ঢাকার বাজারে গরুর মাংসের কেজি আবার ৭০০-৭৫০ টাকা হয়েছে, যা মাসখানেক আগেও ৬৫০ টাকা ছিল। ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৯০-২০০ টাকা। এই দর কমছেই না। ফার্মের মুরগির বাদামি ডিমের ডজন ১৪০ টাকার আশপাশে, যা এক মাস আগেও ১৩০ টাকার আশপাশে ছিল।

মুরগি ও ডিমের দাম ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকেই চড়া। এর আগে প্রতি ডজন ডিমের দাম সাধারণত ৯০ থেকে ১১০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করত। ব্রয়লার মুরগি থাকত ১৩০ থেকে ১৫০ টাকার মধ্যে।

আমদানি এখনো কম

চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্য বলছে, শুল্ক কমানোর পর আমদানিকারকেরা ভোজ্যতেল, চিনি ও খেজুর খালাস বাড়িয়েছেন। বাস্তবে চিনিতে কেজিতে ৬৮ পয়সা, ভোজ্যতেল লিটারে ৫-৬ টাকা এবং উন্নতমানের খেজুরে কেজিতে ৫৪ টাকা ছাড় পাওয়া যাচ্ছে।

চট্টগ্রামের পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে এখনো শুল্কছাড়ের প্রভাব খুব একটা পড়েনি। সয়াবিন তেলের দাম কমেছে লিটারে এক টাকার কিছু বেশি। চিনি ও পাম তেলের দামে কোনো পরিবর্তন হয়নি।

রোজার পণ্যের মধ্যে ছোলার সরবরাহ বেশ ভালো। তবে চিনি, ভোজ্যতেল, খেজুর, মটর ডাল ও মসুর ডালের আমদানি এখনো কম। কাস্টমসের তথ্য বলছে, গত নভেম্বর থেকে ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে সয়াবিন তেল আমদানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৯ শতাংশ, অপরিশোধিত চিনি ১৫ শতাংশ, মসুর ডাল ২০ শতাংশ ও খেজুর ৬৫ শতাংশ কমেছে। ২ শতাংশ বেড়েছে পাম তেল আমদানি। ছোলা আমদানি বেড়েছে ১৯ শতাংশ।

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) তথ্য বলছে, আমদানির ঋণপত্র খোলা বেড়েছে। ফলে সরবরাহে সমস্যা হবে না।

পবিত্র রমজান মাস শুরু হতে এক মাসের মতো বাকি আছে। পবিত্র শবে বরাতের পরই শুরু হবে পাইকারি বাজারে রোজার কেনাবেচা। ব্যবসায়ী ও বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, হাতে সময় বেশি নেই। পণ্য দ্রুত আমদানি করে বাজারে ছাড়তে হবে। আর ডিম, মুরগি ও গরুর মাংসের মতো পণ্যের ক্ষেত্রে আমদানির কৌশল না নিলে দাম কমবে না।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বাজারে দরকার পর্যাপ্ত সরবরাহ, যাতে দামের প্রতিযোগিতা হয়। সরবরাহ সংকট থাকলে কোনো উদ্যোগই কাজে আসবে না।