ঢাকায় গরুর চামড়ার দাম কিছুটা বেড়েছে, ছাগলের চামড়া ৫ টাকারও কম

বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা কোরবানির পশুর চামড়া ট্রাক থেকে নামানো হচ্ছে। আজ বৃহস্পতিবার পুরান ঢাকার পোস্তা এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

পবিত্র কোরবানির ঈদের দিনে রাজধানী ঢাকায় মাঝারি আকারের (২১-৩০ বর্গফুট) প্রতি পিস কাঁচা চামড়া বিক্রি হয়েছে ৬০০ থেকে ৮৫০ টাকা। গত বছর কোরবানির ঈদে এই আকারের চামড়া বিক্রি হয়েছিল ৫০০ থেকে ৭৫০ টাকা দরে। আজ বৃহস্পতিবার পুরান ঢাকার পোস্তাসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।

চামড়া ব্যবসায়ী ও আড়তদারেরা বলছেন, গত বছরের তুলনায় কাঁচা চামড়ার দাম কিছুটা বেড়েছে। অন্যদিকে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের দাবি, সরকারের নির্ধারিত দামের চেয়ে তাঁরা কম পাচ্ছেন।

এদিকে গরুর চামড়ার দামে কিছুটা বাড়তি প্রবণতা থাকলেও ছাগলের চামড়ার কোনো দামই পাননি বিক্রেতারা। মাত্র পাঁচ টাকা বা তারও কম দামে প্রতি পিস ছাগলের চামড়া বিক্রি হতে দেখা গেছে।

অন্যান্যবার চামড়া ব্যবসায়ীদের দুশ্চিন্তার কারণ থাকে অতিরিক্ত গরম আবহাওয়া। কারণ, বেশি গরমে চামড়া নষ্ট হয়ে যায়। এবার ঈদের দিন সকাল থেকেই বৃষ্টি হয়েছে। তাই গরমে চামড়া নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি ছিল না। কিন্তু বৃষ্টির কারণে চামড়া সরবরাহে কিছুটা দেরি ও ধীরগতি দেখা যায়। অবশ্য বিকেল থেকে সরবরাহ বাড়তে থাকে।  

রাজধানীতে কোরবানির চামড়া ক্রয়-বিক্রয়ের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো পুরান ঢাকার পোস্তা এলাকা। সেখানে আজ বেলা তিনটার দিকে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে রিকশা, ভ্যান ও ট্রাকে করে হাজার হাজার চামড়া নিয়ে আসছেন কোরবানিদাতা, মৌসুমি ব্যবসায়ী এবং বিভিন্ন মাদ্রাসা ও এতিমখানা কর্তৃপক্ষ। সেই চামড়া নেড়েচেড়ে দেখে তারপর দাম বলেন পোস্তার আড়তদারেরা।

দাম বেড়েছে, তবে কাঙ্ক্ষিত নয়

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত সপ্তাহে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে চলতি বছর ঢাকায় লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুটে ৩ টাকা বাড়িয়ে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় নির্ধারণ করে দেয়। ঢাকার বাইরে দাম নির্ধারণ করা হয় ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা।

মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত দাম অনুযায়ী ঢাকার মধ্যে মাঝারি আকারের ২৫ বর্গফুটের একটি লবণ দেওয়া চামড়ার দাম হওয়ার কথা ১ হাজার ২৫০ থেকে ১ হাজার ৩৭৫ টাকা। এই হিসাব থেকে লবণ, মজুরি ও অন্যান্য খরচবাবদ ৩০০ টাকা বাদ দিলে ওই চামড়ার আনুমানিক মূল্য দাঁড়ায় ৯৫০ থেকে ১ হাজার ৭৫ টাকা।

কিন্তু আজ পুরান ঢাকার পোস্তাসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখা গেছে, মাঝারি আকারের চামড়া বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ৮৫০ টাকার মধ্যে; অর্থাৎ সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে তুলনামূলক কম দামে কাঁচা চামড়া বিক্রি হচ্ছে।

কামরাঙ্গীরচর থেকে পাঁচটি মাঝারি আকারের চামড়া নিয়ে পোস্তায় আসেন জামেয়া ইসলামীয়া ফোরকানিয়া মাদ্রাসার পরিচালক মাহবুবুর রহমান। তিনি একটি আড়তে প্রতি পিস চামড়ার দাম ১ হাজার ২০০ টাকা করে ৬ হাজার টাকা দাবি করেন। কিন্তু তাঁকে প্রতি পিসের জন্য প্রথমে ৭০০ টাকা করে দাম বলেন এক আড়তদার। এ নিয়ে মিনিট দুয়েক ধরে দর-কষাকষি চলে। শেষমেশ ৮৫০ টাকা দরে মোট ৪ হাজার ২৫০ টাকায় পাঁচটি চামড়া বিক্রি হয়।

জানতে চাইলে মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের তুলনায় প্রতি পিসে ৫০ টাকা লাভ পেয়েছি। কিন্তু চামড়ার আকার ও সরকার নির্ধারিত দাম অনুসারে দাম আরও বেশি হওয়া উচিত ছিল।

আজ রাজধানীর অন্যান্য এলাকাতেও মোটামুটি একই চিত্র দেখা গেছে। বেলা দেড়টার দিকে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় গিয়ে যায়, সেখানে বেশ কয়েকটি ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। চামড়া সংগ্রহকারীরা মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চামড়া কিনে ওই সব ট্রাকে তুলে আড়তে পাঠাচ্ছেন। অনেক আড়তদার সায়েন্স ল্যাব এলাকা থেকে চামড়া সংগ্রহ করেন। রাজধানীর কলাবাগান এলাকা থেকে ছোট-বড় ২২ পিস চামড়া নিয়ে সেখানে আসেন মৌসুমি ব্যবসায়ী মো. রমজান হোসেন। তিনি মাঝারি মানের চামড়াগুলোর দাম চেয়েছেন এক হাজার টাকা করে। কিন্তু তাঁকে প্রাথমিকভাবে কোনো আড়তদার ৮০০ টাকার বেশি দাম বলেননি। দর-কষাকষির পর ৮৫০ টাকা করে তিনি কয়েকটি চামড়া বিক্রি করেন।

রমজান হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছরের তুলনায় চামড়ার দাম একটু বেশি। কিন্তু তাতে আমাদের খুব একটা লাভ হচ্ছে না।’

আজ বৃহস্পতিবার ঈদের দিনে পুরান ঢাকার পোস্তা এলাকার একটি আড়তে চামড়া সংরক্ষণে তাতে লবণ দিয়ে রাখছেন শ্রমিকেরা
ছবি: প্রথম আলো

আড়তদারদের দাবি ভিন্ন

পোস্তার আড়ত শুরাইম এন্টারপ্রাইজের পক্ষে চামড়ার দরদাম করছিলেন হাবীবুর রহমান নামের একজন। এ বছর দরদাম কেমন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, চামড়ার দাম তো বেড়েছে। কিন্তু লবণের দামও অনেক বেড়েছে। তা না হলে কাঁচা চামড়ার আরও বেশি দাম পেতেন মৌসুমি বিক্রেতারা। পোস্তার আরও কয়েকজন আড়তদারও একই ধরনের কথা বলেছেন।

প্রায় ৪০ বছর ধরে পোস্তায় কাঁচা চামড়ার ব্যবসা করছে মাহবুব অ্যান্ড ব্রাদার্স নামের আড়ত। এ বছর তারা ছয় হাজার পিস চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। জানতে চাইলে মাহবুব অ্যান্ড ব্রাদার্সের পরিচালক আবু তাহের প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছরের চেয়ে চামড়ার দাম বেড়েছে। সরকার লবণযুক্ত চামড়ার যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে, মোটামুটি সেই হিসাবেই আমরা কাঁচা চামড়া কিনছি।’  

ছাগলের চামড়ার যেন দামই নেই

এ বছর গরুর চামড়ার দাম কিছুটা বাড়লেও খাসি ও বকরির চামড়ার দাম বাড়ায়নি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ হিসাবে গত বছরের মতো এবারও খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১৮ থেকে ২০ টাকা এবং বকরির চামড়া ১২ থেকে ১৪ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা।

কিন্তু আজ সরেজমিনে দেখা গেল সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। ছাগলের চামড়া নিয়ে কোনো আগ্রহই যেন নেই আড়তদার ও ট্যানারির মালিকদের। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা ছাগলের চামড়ার দরদাম করেননি। এ কারণে অনেক বিক্রেতা ছাগলের চামড়া ফেলে যান কিংবা নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করেন।  

রাজধানীর কল্যাণপুর থেকে ছাগলের ১০টি চামড়া নিয়ে সায়েন্স ল্যাব এলাকায় আসেন একটি মাদ্রাসার শিক্ষক এহসান উল্লাহ। একে একে ছয়জন ক্রেতার কাছে এই চামড়া নিয়ে যান তিনি। কিন্তু তাঁদের কেউই কিনতে আগ্রহ দেখাননি। পরে এক ক্রেতা ১০টি চামড়ার জন্য মাত্র ৩০ টাকা দেওয়ার প্রস্তাব করেন।

ছাগলের চামড়ার দাম এত কম কেন, তা জানতে চাইলে পোস্তা এলাকা থেকে আসা আড়তদার কামাল বলেন, একটা চামড়া ১০ টাকা দিয়ে কিনলে এর পেছনে সব মিলিয়ে প্রায় ৪০ টাকা খরচ হয়। কিন্তু ট্যানারিতে বিক্রির সময় ২০-৩০ টাকার বেশি পাওয়া যায় না। এ কারণেই এখন কেউ ছাগলের চামড়া কিনতে চান না।

সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছরের তুলনায় চলতি বছর গরুর চামড়ার দাম বেড়েছে। চলতি বছর ট্যানারিগুলো এক কোটির মতো চামড়া সংগ্রহ করতে পারবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।’