৬০০ টাকায় শুরু, এখন ব্যবসা কোটি টাকার
২০১৭ সালে অনলাইনে আম বিক্রি দিয়ে ব্যবসার শুরু মো. মাহমুদুন্নবী সোহাগের। নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার এই যুবক এখন মাসে প্রায় কোটি টাকার তিন শতাধিক কৃষিপণ্য বিক্রি করেন। ঢাকায় তিনটিসহ মোট চারটি শাখা থেকে এসব পণ্য বিক্রি করা হয়। মৌসুমি ফল থেকে শুরু করে শীত কিংবা ঈদ ঘিরে আলাদা পণ্যও বিক্রি করেন তিনি। তাতে সব মিলিয়ে বার্ষিক বিক্রির পরিমাণ দাঁড়ায় ২০ কোটি টাকার বেশি।
সোহাগের ‘শতমূল এগ্রো’ নামের প্রতিষ্ঠানে এরই মধ্যে সরাসরি কর্মসংস্থান হয়েছে ৪৭ জনের। আর চুক্তিভিত্তিক চাষি রয়েছেন ১৫০ জন। এ ছাড়া ৫০০ জন কৃষক থেকে প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন ধরনের কৃষিপণ্য সংগ্রহ করে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে নাটোরের বড়াইগ্রাম আহমেদপুরে রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছেন এই তরুণ।
প্রতিষ্ঠানটি যেসব পণ্য বিক্রি করে, তার মধ্যে রয়েছে—চাল, ডাল, মসলা, ঘি, নিজস্ব খামারের গরু, মহিষ, মুরগি, হাঁস ও কোয়েলের মাংস। এ ছাড়া দুধ, চিংড়ি মাছ, খেজুরের গুড়, লাচ্ছা সেমাই, আম, বিভিন্ন মৌসুমি ফলসহ কয়েক শতাধিক কৃষিপণ্য। নিজেদের খামারে উৎপাদনের পাশাপাশি স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে কৃষিপণ্য সংগ্রহ করে প্রতিষ্ঠানটি। নিজস্ব আউটলেট ও অনলাইনে বিক্রির পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন সুপারশপ ও ব্যান্ডের দোকানে পণ্য সরবরাহ করে শতমূল এগ্রো।
ঢাকার বনশ্রীতে দুটি, উত্তরাতে ও বগুড়াতে একটি করে মোট চারটি আউটলেট রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। শতমূল এগ্রোর চালের চাতাল, শর্ষের মিল, দই ও লাচ্ছি কারখানা রয়েছে বগুড়ার শেরপুরে। মহিষের ও মাছের খামার রয়েছে বড়াইগ্রামে। পাবনার দাপুনিয়াতে রয়েছে গরু, ভেড়া, হাঁস ও মুরগির খামার।
শুরু যেভাবে
গ্রাম থেকে ঢাকায় পড়াশোনার জন্য এসে শহুরে খাবারের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছিলেন না সোহাগ। তাই ঢাকা পলিটেকনিকের এই শিক্ষার্থী নিয়মিত বাসা থেকে মসলা নিয়ে আসতেন। তখন তিনি উপলব্ধি করলেন, ঢাকায় নিরাপদ খাবারের বড় একটি বাজার রয়েছে। আমের মৌসুমে অনেকে রাজশাহীর আম চাইত। তখন এলাকা থেকে আম কিনে সেই আম বিক্রির মাধ্যমে ব্যবসা শুরু হয় শখের বসে, তা–ও মাত্র ৬০০ টাকায়, সেটিও ২০১৭ সালে। দশক না ঘুরতেই এখন প্রতিষ্ঠানটির সম্পদের পরিমাণ চার কোটি টাকার বেশি।
বন্ধুদের চাহিদা মেটাতে আম দিয়ে ব্যবসা শুরুর পর আমের মৌসুম শেষে সোহাগের মনে হলো আর কি বিক্রি করা যায়। পরে শীতের মৌসুমে নাটোরের বিখ্যাত খেজুরের গুড় বিক্রি শুরু করেন। দুটি পণ্যের পর বাড্ডায় একটি কৃষিপণ্যের আউটলেটে গিয়ে দেখেন নানা পণ্যের ব্যাপক চাহিদা। সেটা দেখে ২০১৭ সালেই মিরপুরে একটি আউটলেট খোলেন। কিন্তু করোনায় সময় সেটি বন্ধ করে দিতে হয়। করোনার প্রকোপ কমলে বনশ্রীতে আবার শুরু করেন। পরে একটার পর একটা নতুন পণ্য যুক্ত হতে থাকে আউটলেটে। আউটলেটের সংখ্যাও বাড়ানো হয়। তবে নিজের আউটলেটের চেয়ে বিভিন্ন ব্র্যান্ড ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বিক্রিটা এখন বেশি।
শতমূল এগ্রোর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী মো. মাহমুদুন্নবী সোহাগ প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিরাপদ খাদ্য সবার মাঝে পৌঁছে দিতে ৫ বছরের মধ্যে সারা দেশে ৩০টি আউটলেট চালু করতে চাই। সে জন্য উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ানো এবং রপ্তানিরও পরিকল্পনা করছি।’
নিরাপদ খাদ্য সবার মাঝে পৌঁছে দিতে ৫ বছরের মধ্যে সারা দেশে ৩০টি আউটলেট চালু করতে চাই। সে জন্য উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ানো এবং রপ্তানিরও পরিকল্পনা করছি।মো. মাহমুদুন্নবী সোহাগ, প্রতিষ্ঠাতা, শতমূল এগ্রো
গ্রামে কাজের সুযোগ
বড়াইগ্রামে কৃষিবিপ্লবের মাধ্যমে শুধু নিজের নয়, গ্রামের যুবক ও কৃষকদের অবস্থার পরিবর্তন এনেছে শতমূল এগ্রো। প্রতিষ্ঠানটির বিপণন ও সরবরাহ বিভাগে কাজ করছে সোহান জান্নাত। নাটোরের নবাব সিরাজউদ্দৌলা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশোনা করছেন তিনি। আগে ঢাকায় একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে ১৮ হাজার টাকা বেতন পেলেও খরচ শেষে বাড়িতে টাকা পাঠাতে কষ্ট হতো। আর এখন বাড়িতে বসেই ১০ হাজার টাকার বেশি বেতন পাচ্ছেন এ শিক্ষার্থী। তাই কাজ ও পড়াশোনা নিয়ে সন্তুষ্টির কথা তিনি প্রথম আলোকে জানান। এভাবে বেশ কিছু তরুণের গ্রামেই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে শতমূল এগ্রো।
এ ছাড়া স্থানীয় চাষিদের এখন আর আবাদের অগ্রিম টাকার জন্য ঋণের পেছনে ছুটতে হয় না। চাষিদের সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক চাষের ব্যবস্থা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বড়াইগ্রামের আহমেদপুরের চাষি রাসেল মিয়া এখন চার একর জমিতে হলুদ, আনারস, কলা, কমলা হলুদ ও আখের আবাদ করছেন। ফসলের দাম পেয়ে তিনিও খুশি। অনেক চাষি এখন নতুন নতুন অর্থকরী ফসলের আবাদের প্রতি ঝুঁকছেন।
নিরাপদ কৃষি
অন্য কৃষিপণ্যের সঙ্গে শতমূলের পণ্যের পার্থক্য নিয়ে জানতে চাইলে তারা নিরাপদ কৃষির কথা জানান। অর্থাৎ সার বা অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার না করে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে উৎপাদন করা। উদ্যোক্তা সোহাগ বলেন, ‘প্রথমে আমরা খেজুরের গুড় করতে গিয়ে দেখলাম চিনি, চুন, রং ও কেমিক্যাল মেশানো হয়। আমরা বললাম, এসব ছাড়া গুড় বানিয়ে দিতে হবে। দেখতে কেমন হবে, সেটা নিয়ে আমাদের কোনো চিন্তা নাই। পরে অগ্রিম টাকা দিয়ে আমরা নিরাপদ গুড় করা শুরু করলাম। এভাবে কাঠের ঘানিতে ভাঙানো শর্ষের তেল তৈরি করি। তা ছাড়া টাঙ্গাইলে তিন বছরের জন্য জমি লিজ নিয়ে আমরা জৈব পদ্ধতিতে সবজি চাষ করছি।’
সোহাগ আরও জানান, দেশের দৈনন্দিন খাদ্যের বাজারে ২ শতাংশ এখন নিরাপদ খাদ্যের আওতায় আসেনি। তাই কৃষিজাত খাদ্যপণ্যে নিরাপদ কৃষির অংশ বাড়ানোর অনেক সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে অর্থায়ন একটি বড় সমস্যা। তাই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য গঠিত বিভিন্ন তহবিল থেকে ঋণ প্রদানের দাবি জানান মো. মাহমুদুন্নবী সোহাগ