ঠিকানা পাল্টে ব্যবসা বাঁচানোর চেষ্টায় বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা

আগুনে পুড়ে যাওয়া বঙ্গবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জন্য অস্থায়ীভাবে চৌকি বিছিয়ে ব্যবসার সুযোগ করে দেওয়া হয়। ঈদের ছুটিতে ব্যবসায়ীরা বাড়ি যাওয়ায় ফাঁকা পড়ে আছে এসব চৌকি। গতকাল দুপুরেছবি: সাজিদ হোসেন

ঈদের আগে রাজধানীর বঙ্গবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা চৌকিতে বসে অস্থায়ীভাবে দোকান করার সুযোগ পেলেও প্রচণ্ড রোদের কারণে তাঁদের ব্যবসা জমেনি। অর্ধেক চৌকিই ছিল খালি। এদিকে সামনে যখন-তখন ঝড়-বৃষ্টি হতে পারে। আর ব্যবসায়ীরা উন্মুক্ত স্থানেইবা ঠিক কত দিন ব্যবসা করতে পারবেন, সেই নিশ্চয়তাও নেই। ফলে ব্যবসায়ীদের বড় অংশ এখনো দিশাহারা। তবে সামর্থ্যবান কোনো কোনো ব্যবসায়ী দোকানের ঠিকানা বদলানোর কথা ভাবছেন। তাঁরা আশপাশের বিভিন্ন মার্কেটে জায়গা খুঁজছেন বলে জানা গেছে।

বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁদের অস্থায়ীভাবে চৌকিতে বসানোর সময় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন জানিয়েছিল যে ঈদুল ফিতর পর্যন্ত ব্যবসায়ীরা সেখানে দোকান করতে পারবেন। এরপর স্থায়ী পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু স্থায়ী পুনর্বাসনের ধরন কেমন হবে, তা এখনো খোলাসা করা হয়নি। ব্যবসায়ী কিংবা ব্যবসায়ী নেতারাও জানেন না পুড়ে যাওয়া বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের জায়গায় কবে আবার মার্কেট গড়ে উঠবে। সে জন্য সার্বিক অনিশ্চয়তার কথা ভেবে কিছু ব্যবসায়ী আশপাশের মার্কেটে দোকান নিয়ে ব্যবসা টেকানোর চেষ্টায় আছেন।

ঠিক কতজন ব্যবসায়ী ইতিমধ্যে ব্যবসা সরিয়ে নিয়েছেন বা নেবেন, সেই তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে বঙ্গবাজারের আশপাশে বিভিন্ন জায়গায় স্থান পরিবর্তনের ব্যানার লাগিয়েছেন কিছু ব্যবসায়ী। এসব ব্যবসায়ীর বেশির ভাগই ফুলবাড়িয়া এলাকার সিটি প্লাজা, বরিশাল প্লাজা ও গোল্ডেন প্লাজায় দোকান নিয়েছেন। যাঁরা গার্মেন্টসের স্টক লটের ব্যবসা করেন, তাঁরা মিরপুরের দিকে গেছেন।

বঙ্গবাজারের ভূঁইয়া প্যান্ট ঘর এখন আছে ফুলবাড়িয়া সিটি প্লাজার দোতলায়। দোকানটির স্বত্বাধিকারী মো. ইউসুফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যবসাটা চালু রাখতে না পারলে নিয়মিতভাবে যেসব ক্রেতা আমাদের কাছ আসতেন, তাঁরা অন্য জায়গা থেকে মালামাল নেওয়া শুরু করবেন। এ জন্য আমরা দোকান স্থানান্তর করে ব্যবসা টেকানোর চেষ্টা করছি।’  

জানা গেছে, বঙ্গবাজারের কোনো কোনো ব্যবসায়ী পার্শ্ববর্তী মার্কেটের দোকানদারদের সঙ্গে দোকান ভাগাভাগি করে ব্যবসা করছেন। আবার যাঁদের অন্য মার্কেটেও দোকান ছিল, তাঁরা সেখানেই দোকান করায় জোর দিচ্ছেন। তবে ব্যবসায়ীরা আপাতত দোকান সরিয়ে ব্যবসা চলমান রাখলেও দীর্ঘ মেয়াদে তাঁরা ব্যবসা নিয়ে বঙ্গবাজারেই ফিরে আসতে চান।

বঙ্গবাজারে পুড়ে যাওয়া সুরাইয়া বেল্ট কর্নারের স্বত্বাধিকারী শহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বঙ্গবাজারই আমাদের ঠিকানা। বঙ্গবাজারে বসার ব্যবস্থা না হলে আমাদের ব্যবসা থাকবে না। আমার আরও একটি দোকান আছে। কিন্তু সে দোকানটাও বঙ্গবাজারের ব্যবসার ওপরেই হয়েছে।’ শহিদুল ইসলাম মনে করেন, নতুন মার্কেট গড়ে উঠলে দোকান বেহাত হতে পারে, এমন আশঙ্কায় অনেক ব্যবসায়ী সহজে বঙ্গবাজার ছাড়বেন না।

এ ব্যাপারে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স ব্যবসায়ী সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক দুলাল আহমেদ খান বলেন, ব্যবসায়ীরা টিকে থাকার জন্য নানাভাবে লড়ছেন। ঈদের আগে তাঁরা ব্যবসার জন্য অস্থায়ীভাবে চৌকিতে বসেছিলেন। তবে বেচাকেনা ভালো হয়নি। এসব ব্যবসায়ী হয়তো সর্বোচ্চ আগামী ঈদুল আজহা পর্যন্ত বসতে পারবেন। এখন রোদ বেশি, সামনে ঝড়-বৃষ্টির হবে। তাতে খোলা মাঠে ব্যবসা করা কষ্টকর হবে। পূর্ণাঙ্গ পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া শুরু হলে ব্যবসায়ীদের বিকল্প ঠিকানা খুঁজতেই হবে।

জামানতবিহীন ও বিনা ভাড়ায় দোকান
দোকানের ঠিকানা পাল্টানো সবার জন্য সহজ হবে না উল্লেখ করে বঙ্গবাজারের পাইকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আরএফসির স্বত্বাধিকারী হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বঙ্গবাজারের যে পরিস্থিতি, তাতে এখানে বড় আকারের ব্যবসা চালিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। আবার অন্য মার্কেটে যাওয়ার মতো টাকা নেই। তাই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জন্য জামানত ছাড়া দোকানের ব্যবস্থা করা গেলে ভালো হবে। সে ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা টিকে থাকার লড়াইটা অন্তত করতে পারবেন।

অনেক ব্যবসায়ী আর্থিক অবস্থার কথা চিন্তা করে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। ভিনটেজ নাইনটি নাইন নামের প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী রুবেল হোসেন বলেন, ‘আমাদের যে অবস্থা, তাতে ইচ্ছা করলেই দোকান নেওয়া সম্ভব নয়। সে জন্য এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। ঈদের আগে অস্থায়ীভাবে একটা জায়গা নিয়ে ব্যবসা করেছি। তবে ব্যবসা চালাতে গেলে স্থান পরিবর্তনের বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে।’  

এদিকে বঙ্গবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জন্য জামানতবিহীন ও বিনা ভাড়ায় দোকান বরাদ্দের ঘোষণা দিয়েছে রাজধানীর ডেমরা এলাকার একটি বিপণিবিতান। কোনাপাড়া শপিং কমপ্লেক্স নামের নির্মীয়মাণ এই বিপণিবিতানে বঙ্গবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা প্রাথমিকভাবে তিন মাস বিনা ভাড়ায় ব্যবসা করতে পারবেন। শর্ত সাপেক্ষে এই সময়সীমা বাড়তে পারে।

কোনাপাড়া শপিং কমপ্লেক্সের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নির্মীয়মাণ এই বিপণিবিতান আগামী ঈদুল আজহার আগে পুরোপুরি চালু করা সম্ভব হবে। তাতে বঙ্গবাজারের যেসব ব্যবসায়ীর সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, তাঁরা সেখানে জামানতবিহীন দোকান নিতে পারবেন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বঙ্গবাজারে সব মিলিয়ে ৩ হাজার ৮৪৫টি দোকানের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৩০৩ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে মালপত্রের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ২৮৮ কোটি টাকার বেশি। আর মার্কেটগুলোর কাঠামোগত ক্ষতির পরিমাণ ১৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা।