আদানি যেভাবে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়ে সমালোচনা বন্ধ করে

গৌতম আদানি
ফাইল ছবি

ভারতের স্বাধীন সাংবাদিক পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতার বিরুদ্ধে গৌতম আদানির ব্যবসা–সাম্রাজ্য ছয়টি আলাদা আদালতে মামলা করেছে এবং তাঁর এই শিল্পগোষ্ঠী কিংবা এর মালিকের ব্যাপারে কোনো কথা বলার অনুমতি নেই।

মার্কিন বিনিয়োগ কোম্পানি হিনডেনবার্গ রিসার্চ, গত মাসে প্রকাশিত যাদের প্রতিবেদনের কারণে আদানির শেয়ার ১২ হাজার কোটি ডলার মূলধন হারিয়েছে, বলছে যে আদানি দীর্ঘদিন ধরেই মামলার ভয় দেখিয়ে তাদের ব্যাপারে আরও খোঁজখবর করাকে ঠেকিয়ে রেখেছে।

বার্তা সংস্থা এএফপি বলছে, হিনডেনবার্গ শেয়ারবাজারে শর্টসেল করে। তবে তারা শুধু কোনো কোম্পানির অনিয়ম খুঁজে বেরোয় এমন নয় বরং ওই কোম্পানির শেয়ারের যখন দরপতন ঘটে, তখন তার ওপর বাজি ধরে তারা টাকাও বানায়।

বিশ্বজুড়ে বন্দর থেকে বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ করা ভারতীয় এই কোম্পানির বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ যে এটি হিসাব জালিয়াতি করেছে এবং শেয়ারের দাম বাড়াতে কারসাজিও করেছে। হিনডেনবার্গের আরও অভিযোগ যে আদানির ‘প্রতিশোধের ভয়ে বিনিয়োগকারী, সাংবাদিক, নাগরিক এবং এমনকি রাজনীতিবিদরা পর্যন্ত কথা বলতে আতঙ্ক বোধ করেন।’

আরও পড়ুন

সাতষট্টি বছর বয়স্ক ঠাকুরতার বিরুদ্ধে ঠুকে দেওয়া হয়েছে ছয়টি মানহানির মামলা। এর মধ্যে তিনটি ফৌজদারি অপরাধের মামলা। আর এসব ঘটেছে আদানির ওপর একের পর এক প্রতিবেদন করার পরে। একটি প্রতিবেদনে এমন অভিযোগ করা হয়েছে যে একজন শীর্ষস্থানীয় বিচারক আদানিকে বিশেষ সুবিধা দিয়েছেন।
অপরাধ প্রমাণিত হলে তাঁর কারাদণ্ড হতে পারে। তবে আদালতের একটি আদেশে নিষেধ করা হয়েছে যে তিনি এই কোম্পানি এবং এর মালিক সম্পর্কে কিছু লিখতে বা বলতে পারবেন না।

‘আমাকে মুখ বন্ধ রাখতে আদেশ দেওয়া হয়েছে’, তিনি বলেন। ‘আমাকে বলা হয়েছে যে আমি মিস্টার গৌতম আদানি এবং তার ব্যবসা–প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে পারব না। তাই আমি আদালত অবমাননা করতে চাই না।’

তবে তাঁর সহকর্মী আবির দাশগুপ্ত বলেন, ‘আইনি খরচ ও তিনটি রাজ্যে শুনানিতে অংশ নেওয়ার কারণে আমাদের শারীরিক এবং মানসিকভাবে ধকল পোহাতে হচ্ছে।’ তাঁর বিরুদ্ধেও তিনটি মানহানির মামলা রয়েছে।

‘এটা আমাদের সময় খেয়ে নিচ্ছে, আমাদের পরিবারকে বিপদে ফেলছে, আমাদের সময় নষ্ট করছে এবং আমাদের সবার আয়ে ধস নামাচ্ছে।’

হিনডেনবার্গের গত মাসের প্রতিবেদনের পর আদানি গ্রুপ এখন ক্ষত সারাতে মাঠে নেমেছে। ওই প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে, কোম্পানিটি কৃত্রিমভাবে তাদের বাজার দর বাড়িয়েছে।

প্রতিবেদন প্রকাশের আগে পর্যন্ত আদানি ছিলেন এশিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। তবে এরপর এই শত কোটিপতির সম্পদে ধস নামে, তিনি নিজে ধনীর তালিকায় নিচের দিকে নামতে থাকেন। তাঁর তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর শেয়ার অবশ্য এরপর খানিকটা স্থিতিশীল হয়েছে।

আদানি তাদের সম্পর্কে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করে হিনডেনবার্গের বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দিয়েছে।

এই কোম্পানি আগেই বিদেশে তাদের সমালোচকদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার পরিবেশবাদী বেন পেনিংস। দাবি করা হয়েছে যে কুইন্সল্যান্ডে আদানির কয়লাখনির বিরুদ্ধে তার আন্দোলনের ফলে কোম্পানির লাখ লাখ ডলার ক্ষতি হয়েছে।

আদানির মালিকানাধীন একটি কোম্পানি সিএনবিসি টিভি১৮–এর দুজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মানহানির মামলা করেছে। অভিযোগ, তারা ‘বিদ্বেষপূর্ণ, মানহানিকর এবং মিথ্যা’ সংবাদ পরিবশন করেছেন।

তবে আদানির একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘আদানি গ্রুপ সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে এবং অন্য যেকোনো কোম্পানির মতো তাদেরও মানহানিকর, বিভ্রান্তিকর এবং মিথ্যা বিবৃতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার রয়েছে’।

আদানির একজন মুখপাত্র আরও বলেন, অতীতে কখনো কখনো আদানি তাদের এই অধিকারের বিষয়টি ব্যবহার করেছে। গ্রুপটি সব সময়ই প্রচলিত আইন অনুযায়ী কাজ করেছে।

হিনডেনবার্গের করা অভিযোগ বিশ্বজুড়ে সংবাদমাধ্যমে হেডলাইন হয়েছে। কিন্তু ভারতের অনেক গণমাধ্যম হয়—এগুলো এড়িয়ে গেছে কিংবা বাতিল করে দিয়েছে, অথবা প্রতিবেদন যারা লিখেছেন তাদের নিন্দামন্দ করেছে।

অনেকেই আদানির সুরে সুর মিলিয়েছে যে হিনডেনবার্গের প্রতিবেদন ইচ্ছাকৃতভাবে ‘ভারতকে আক্রমণ’ করেছে। একটি টেলিভিশনে এমন কথাও বলা হয়েছে যে এটি ছিল দেশের প্রতি ‘আর্থিক সন্ত্রাস’–এর একটি ঘটনা।

এই ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ। একজন বিরোধী সাংসদ বলেছেন যে তাদের এই পারস্পরিক সম্পর্কের কারণে দুজনই লাভবান হয়েছেন। সমালোচকেরা বলেন, আদানির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখতে ভারতীয় গণমাধ্যমের যে অনাগ্রহ, তা আসলে ওই দুই ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ সম্পর্কেরই একটি প্রতিফলন।

নিউজলন্ড্রির সাংবাদিক মণীষা পান্ডে বলেন, ‘এর অন্যতম কারণ হলো আদানির গল্প এবং মোদির গল্প আসলে একই সুরে বাঁধা’। এই ওয়েবসাইট ভারতের গণমাধ্যমকে সাধারণত একটু কঠোরভাবেই মূল্যায়ন করে।

ভারতে ৪০০–এর মতো টেলিভিশন চ্যানেল রয়েছে। তবে মোদির সরকার সাধারণত ইতিবাচক কভারেজ পেয়ে থাকে।

মণীষা পান্ডের মতে, হিনডেনবার্গের প্রতিবেদনকে দেখা হয়েছে ‘শুধু ওই কোম্পানির বিরুদ্ধে একটি আক্রমণ হিসাবে নয় বরং মোদি তার সিদ্ধান্ত, তার আমলের বিরুদ্ধে একটি আক্রমণ হিসেবে।’

গত ডিসেম্বরে টেলিভিশন চ্যানেল এনডিটিভি অধিগ্রহণের মাধ্যমে আদানি নিজেই গণমাধ্যমের মালিক হয়েছেন। ভারতে যে সামান্য কয়েকটি গণমাধ্যম মোদির সমালোচনা করতে পেছপা হতো না, এনডিটিভি ছিল তার একটি।

তবে এই ধনকুবের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সম্পর্কিত যেকোনো আশঙ্কাকে নাকচ করে দেন। তিনি ফাইনান্সিয়াল টাইমসকে বলেন, সরকার যখন প্রতিদিন সঠিক কাজটি করে, তখন তা তুলে ধরতে সাংবাদিকদের ‘সাহস’ থাকতে হবে।

আদানি এনডিটিভি অধিগ্রহণের মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরেই চ্যানেলটির অন্যতম জনপ্রিয় একজন উপস্থাপক পদত্যাগ করেন। মোদির কড়া সমালোচক রাভিশ কুমার পরে বলেন যে তিনি ‘বিশ্বাস’ করেন আদানির এনডিটিভি কেনার উদ্দেশ্যই হলো ভিন্নমত দমন করা।

নিউজ পোর্টাল দ্য ওয়ারকে তিনি বলেন, আদানি কোনো রকম প্রশ্ন করা কিংবা সমালোচনার বিষয়টি স্থান দেন না।

ঠাকুরতা বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, ভারতে অসংখ্য ব্যবসায়ী নেতা গণমাধ্যমের মালিক হয়েছেন—এমন মতামত এবং তথ্য চাপা দিতে, যা তাদের সুবিধা দেয় না। তিনি বলেন, ভারতীয় গণমাধ্যম করপোরেট জগত এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মধ্যে ‘যোগসূত্র’ হিসাবে কাজ করে।

তাই এটি আশ্চর্যের কোনো বিষয় নয় যে গণমাধ্যমের একটি বড় অংশই বড় ব্যবসায়ীস্বার্থের আজ্ঞাবহ হিসেবে কাজ করে।