এসভিবি: মার্কিন ব্যাংকের ধস কি ২০০৮ সালের মতো আর্থিক সংকট শুরু করতে পারে

সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক
ছবি: রয়টার্স

সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের (এসভিবি) ধসে পড়ার ঘটনা পৃথিবীজুড়ে আর্থিক বাজারে রীতিমতো আতঙ্ক তৈরি করেছে। সেই সঙ্গে উকিঝুঁকি মারতে শুরু করেছে অস্বস্তিকর একটি প্রশ্ন—এই ঘটনা কি আরও ধ্বংস ডেকে এনে পুরো ব্যাংকিং খাতকে পতনের পথে নিয়ে যাবে?

সিএনএন এক বিশ্লেষণে বলেছে, শত কোটি ডলারের মালিক হেজফান্ড ব্যবস্থাপক বিল অকম্যান এসভিবির সঙ্গে বেয়ার স্টানর্সের তুলনা করেছেন। ২০০৭–২০০৮ সালে যে বৈশ্বিক আর্থিক সংকট হয়েছিল, তার সূচনাতেই ধসে পড়েছিল এই ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান।

টুইটারে বিল অকম্যান লিখেছেন, একটি ব্যাংকের ব্যর্থতা এবং আমানত হারানোর ঝুঁকিটি হলো, এ ধরনের ঘটনা যদি কম সম্পদের ব্যাংকে এরপর ঘটে এবং সেটিতে যদি ধস নামে, তাহলে এ ধরনের ঘটনা একের পর এক ঘটতে পারে।

তবে বেশির ভাগ বিশ্লেষক এখন পর্যন্ত এটাই মনে করেন যে এসভিবির ঘটনা শুধু একটি নির্দিষ্ট কোম্পানির ব্যাপার। এটি প্রযুক্তি স্টার্টআপকে ঋণ দিত। কিন্তু অর্থনীতির ধীর গতি এবং সুদের হার দ্রুত বাড়ার কারণে সিলিকন ভ্যালির তহবিল ফুরিয়ে যায় এবং এটি প্রচণ্ড চাপে পড়ে।

ক্যাপিটাল ইকোনমিকসের বাজারবিষয়ক উপ–অর্থনীতিবিদ জোনাস গোল্টারম্যান বলেন, এসভিবি সমস্যায় রয়েছে, কারণ, এটি শুধু নির্দিষ্ট কিছু শিল্পে ঋণ দিত। তিনি জানান, অন্য বেশির ভাগ ব্যাংক অনেক ‘বহুমুখী’।

অন্যদিকে, মার্কিন উপ–অর্থমন্ত্রী ওয়ালি অ্যাডেইয়েমো শুক্রবারে সবাইকে এই বলে আশ্বস্ত করতে চেয়েছেন যে এসভিবি ব্যাংকের পতন হলেও সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতের স্বাস্থ্য ভালো আছে।

সিএনএনকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে ওয়ালি অ্যাডেইয়েমো বলেন, ‘ফেডারেল নিয়ন্ত্রকেরা এই বিশেষ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে নজর দিচ্ছেন। আর আমরা যখন সার্বিকভাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে দেখি, তখন আমরা পুরো ব্যবস্থাটির ক্ষমতা এবং সহনশীলতা নিয়ে খুবই আত্মবিশ্বাসী।’

সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের ধসের পর অর্থমন্ত্রী জেনেট ইয়েলেন আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রকদের নিয়ে একটি অনির্ধারিত বৈঠক করার পর ওয়ালি অ্যাডেইয়েমো ওই মন্তব্য করেন।

অ্যাডেইয়েমো বলেন, ‘সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে, সে ধরনের অবস্থা মোকাবিলা করার মতো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা আমাদের রয়েছে।’

ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগ এবার আরও কম, কারণ, ২০০৮ সালের সংকটের পর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

তবে তারপরও এসভিবির ধস সুদের হার দ্রুত বৃদ্ধির বিষয়টির দিকে সবার নজর ফেরাচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে সুদের হার বাড়িয়েছে। কিন্তু যে গতিতে এটা করা হয়েছে, তা আবার অপ্রত্যাশিত সমস্যা তৈরি করেছে। একই সঙ্গে নতুন কোনো পরিণাম নিয়েও উদ্বেগ শুরু হয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যেসব ব্যাংক সুদের হার খুবই কম থাকার সময় মার্কিন ট্রেজারি বন্ড এবং অন্যান্য বন্ড কিনেছিল, তারা এখন লোকসানের মুখে রয়েছে। কারণ, ঋণ করার খরচ বেড়েছে এবং বন্ডের দাম কমে গেছে।

বিপদে ব্যাংকের শেয়ার

১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এসভিবি যুক্তরাষ্ট্রের মোটামুটি অর্ধেক ভেঞ্চার–ভিত্তিক প্রযুক্তি এবং স্বাস্থ্যসেবা কোম্পানিকে তহবিল জুগিয়েছে। চলতি সপ্তাহে এটি যখন জানায় যে তাদের অর্থের খুবই দরকার, তখনই তাদের সমস্যাগুলো সবার নজরে আসে।

বন্ড বিক্রি করার পর এসভিবির যে লোকসান হয়, তা পূরণ করার জন্য গত বুধবার তারা জানায় যে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ২০০ কোটি ডলার তোলার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। গ্রাহকেরা ব্যাংক থেকে আমানত তোলা শুরু করার পর এসভিবি বন্ড বিক্রি করে।

তবে এরপরই বৃহস্পতিবার এসভিবির শেয়ারের দাম ৬০ শতাংশ পড়ে যায়। শুক্রবার এই খবর ছড়িয়ে পড়ে যে যতটা প্রয়োজন, ঠিক ততটা পরিমাণ অর্থ ব্যাংকটি জোগাড় করতে পারছে না। তারা বরং এমন ক্রেতা খুঁজছে, যে এটি কিনতে পারে। এরপরই এসভিবির শেয়ার বিক্রি বন্ধ হয়ে যায়।

তখন এগিয়ে আসে ক্যালিফোর্নিয়ার ব্যাংক নিয়ন্ত্রকেরা। তারা এসভিবি বন্ধ করে দেয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স করপোরেশনকে রিসিভার হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে আমন্ত্রণ জানায়। গত বছরের শেষে সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ২০ হাজার ৯০০ কোটি ডলার এবং তাদের আমানত ছিল ১৭ হাজার ৫০০ কোটি ডলার।

তবে ব্যাংকিং খাতে যে উদ্বেগ ইতিমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে, তার কিছু আলামত পাওয়া যাচ্ছে। বৃহস্পতিবার জেপি মর্গান চেজ, ব্যাংক অব আমেরিকা, ওয়েলস ফারগো এবং সিটি গ্রুপের শেয়ারের দাম ৪ থেকে ৭ শতাংশ পড়ে গেছে।

শুক্রবার এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম স্থিতিশীল হলেও ছোট ছোট অনেক ব্যাংকের শেয়ারের দাম কমতেই থাকে। ইউরোপের ব্যাংকও এর প্রভাবের বাইরে থাকতে পারেনি।

এরপর কী হবে

বিশেষায়িত আরও অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠানও চাপের মধ্যে পড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। সিলভারগেট বুধবার জানিয়েছে যে তারা কার্যক্রম গুটিয়ে আনছে।

তবে সংকট খুব বড় মাত্রায় ছোঁয়াচে হওয়ার ঝুঁকি এখনো কম।

লন্ডনের কিংস কলেজের ফাইন্যান্সের অধ্যাপক ইয়েনস হ্যাগেনড্রফ বলেন, ‘সব মিলিয়ে ব্যাংকিং খাত ভালো অবস্থায় আছে এবং বড় ধরনের অভিঘাত সামলাতে সক্ষম। আমার মনে হয়, এসভিবির বিষয়টি একটু অন্য রকম, কারণ তাদের আমানতকারীরা কিছুটা অস্থির প্রকৃতির।’

এসভিবির পতনের জন্য কিছুটা দায়ী বন্ডের দাম কমে যাওয়া। ভালো সময়ে তারা বন্ড কিনেছিল। সে সময় তাদের অনেক আমানতকারী ছিল। আর ব্যাংকের দরকার ছিল ওই টাকা কোথাও খাটানো। কিন্তু সুদের হার বেড়ে যাওয়ার পর বন্ডে বিনিয়োগ আর আকর্ষণীয় রইল না। সমস্যা বাড়ে, যখন তাদের হঠাৎ করে অর্থের প্রয়োজন হয়ে পড়ল।

ফন ল্যানশফট কেমপেন সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির জ্যেষ্ঠ পোর্টফলিও ম্যানেজার লুক প্লোভিয়ের বলেন, ‘যখন আপনার দ্রুত টাকার দরকার হবে, তখন যদি বন্ডের দাম কমতে থাকে, তাহলে সেটি একটি সমস্যা। তখন আপনাকে এমন সম্পদ বিক্রি করতে হবে, অন্য সময়ে হয়তো আপনি তা বিক্রি করতেন না।’

তবে এসভিবি ছাড়া হয়তো আরও অনেককে একই ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করতে হতে পারে।
লন্ডনের কিংস কলেজের অধ্যাপক ইয়েনস হ্যাগেনড্রফ বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং পেনশন তহবিল—অনেকেই এমন সব সম্পদ ধরে রেখেছে, যার সত্যিকার মূল্য কাগজে–কলমে দেখানো মূল্যের চেয়ে অনেক কম। ফলে সমস্যা হলো, লোকসান হবে অনেক বেশি এবং সে ক্ষেত্রে বড় তহবিলের দরকার হবে। তাই সমস্যাটির মাত্রা উদ্বেগ তৈরি করছে।