লিফট ও এস্কেলেটর: নিরাপত্তা সবার আগে

লিফটের ক্ষেত্রে ব্যবহারোপযোগিতা ও নিরাপত্তার দিকটা সবার আগেঅলংকরণ: এস এম রাকিবুর

জনগণের চাহিদা অনুযায়ী বাংলাদেশে পর্যাপ্ত আবাসনের জায়গা না থাকায় শহরের ভবনগুলো পাল্লা দিয়ে ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। আবাসিক ভবনের পাশাপাশি অফিস, মার্কেট, হোটেল, হাসপাতাল—এমনকি অনেক কারখানাও এখন বহুতল ভবন হিসেবে নির্মিত হচ্ছে। চলাচল সহজ করার জন্য এসব ভবনে লিফট, এস্কেলেটর ও মুভিং ওয়াক ব্যবহার করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) ২০২০ অনুযায়ী, ৬ তলা বা ২০ মিটার উচ্চতার যেকোনো ভবনে লিফট স্থাপন বাধ্যতামূলক। ভবন ১৫ মিটারের চেয়ে উঁচু হলে সেখানে অন্তত একটি ফায়ার লিফট (ন্যূনতম আটজন যাত্রী বহনক্ষম) থাকা বাধ্যতামূলক। যদিও এই বিধি বাস্তবে কতটা মানা হয়, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। ভবন ১০ তলা বা ৩২ মিটারের বেশি উচ্চতা হলে সেখানে একটি স্ট্রেচার বহনক্ষম লিফট থাকতে হবে। হাসপাতাল ভবন যদি দোতলা বা তার বেশি হয়, সে ক্ষেত্রেও এ ধরনের লিফট আবশ্যক।

লিফট ও এস্কেলেটর একটি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র, যার অনেক যন্ত্রাংশ আমাদের দৃষ্টির বাইরে থাকে। যন্ত্র ব্যবহারে একদিকে যেমন সুবিধা রয়েছে, তেমনই কিছু ঝুঁকিও থেকে যায়। এই অসুবিধাগুলো সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে ভোগান্তি ও বিপদের আশঙ্কা বাড়ে।

মো. হাসমতুজ্জামান প্রকৌশলী ও বিল্ডিং সার্ভিসেস বিশেষজ্ঞ

লিফট বা এস্কেলেটর অবশ্যই কোনো আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করে স্বনামধন্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত হতে হবে। বিএনবিসি অনুযায়ী এএসটিএম/এএনএসআই/ইএন৮১ মান অনুসরণ করার বাধ্যবাধকতা আছে। ন্যূনতম একটি লিফটে স্ট্যান্ডবাই পাওয়ার থাকতে হবে। লিফটে স্বয়ংক্রিয় উদ্ধারকারী যন্ত্র (এআরডি) থাকতে হবে, যা বিদ্যুৎ চলে গেলে যাত্রীকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিকটবর্তী তলায় নিরাপদে নামিয়ে দেবে।

লিফটের শ্যাফট ও দরজা অগ্নিপ্রতিরোধক হতে হবে। লিফটের দরজা ফ্লোরের নির্দিষ্ট স্থান ছাড়া থামতে বা খুলতে পারবে না। লিফটের কারের দরজা ও ফ্লোরের দরজা একসঙ্গে খোলা ও বন্ধ হতে হবে। দরজা বন্ধের সময় কোনো বাধার সম্মুখীন হলে সেন্সরের সহায়তায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে দরজা খুলে যাবে।

লিফটের গতি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকতে হবে। লিফটে অবশ্যই সেফটি গভর্নর থাকতে হবে, যা লিফট দ্রুতগতিতে নিচে পড়তে থাকলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে লিফটকে আটকে দেবে। এতে রশি ছিঁড়ে গেলেও লিফট মাঝপথে থেমে যাবে। লিফট-এস্কেলেটর অত্যন্ত বিদ্যুৎ সংবেদনশীল। বৈদ্যুতিক ভোল্টেজের মান নিয়ন্ত্রণের জন্য অটোমেটিক ভোল্টেজ রেগুলেটর (এভিআর) ব্যবহার করতে হবে।

লিফটের সংস্থাপন, অপারেশন ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রশিক্ষিত ও যোগ্য লোকবল দিয়ে করাতে হবে। বেশির ভাগ সময় লিফট চলতে থাকলেই আমরা সন্তুষ্ট হয়ে ব্যবহার শুরু করি। কিন্তু এর নিরাপত্তা যন্ত্রাংশগুলো (সেফটি ডিভাইস) কাজ করছে কি না, তা পরীক্ষা করা হয় না। ফলে কোনো দুর্ঘটনার সময় সেগুলো কার্যকর না–ও হতে পারে।

লিফটের দরজা, বৈদ্যুতিক তার, রশি, ব্রেক, গিয়ার বক্স, কাউন্টার ওয়েট, সেফটি গিয়ার ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ নিয়মিত পরীক্ষা করে নথিভুক্ত করতে হবে। লিফটের বৈদ্যুতিক অংশ যেমন কন্ট্রোল প্যানেল, ইমার্জেন্সি স্টপ, লিমিট সুইচ, স্মোক ডিটেক্টর, ফায়ার এলার্ম, ইমার্জেন্সি লাইট, ইমার্জেন্সি ইন্টারকম ফোন, আর্থিং ইত্যাদি উপযুক্ত প্রকৌশলী দ্বারা নিয়মিতভাবে পরীক্ষা করাতে হবে।

লিফট বসানোর আগে লিফটের মেশিন রুম, লিফট ওয়েল, গাইড রেল, পিট ইত্যাদির লোড ও ভূমিকম্প সহনীয়তা যাচাই করতে হবে। লিফটের নিরাপত্তা যন্ত্রাংশ, দরজা ইন্টারলক, লাইট বিম, সার্কিট ব্রেকার, ওভারলোড প্রটেকশন ডিভাইস, লুব্রিকেন্ট, হাইড্রলিক ফ্লুইড ইত্যাদি ঠিকঠাক আছে কি না, তা উপযুক্ত প্রকৌশলী দ্বারা পরীক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

আমাদের দেশে প্রতিবছরই কিছু লিফট দুর্ঘটনা ঘটে এবং এতে প্রাণহানিও ঘটে। আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে লিফটের যথাযথ মান যাচাই না করে শুধু বাজারমূল্যের ওপর নির্ভর করে লিফট নির্বাচন করি। অন্যদিকে একবার লিফট স্থাপন করার পর তা নষ্ট না হওয়া পর্যন্ত সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ বা প্রিভেন্টিভ মেইনটেন্যান্স করি না।

বিএনবিসিতে লিফট ও এস্কেলেটর বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা উল্লেখ আছে, যা আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুসরণ করি না। বিএনবিসি পার্ট-২ অধ্যায়-২-তে স্থাপনা কর্তৃপক্ষ—যার আওতায় বাংলাদেশ বিল্ডিং রেগুলেটরি অথরিটি (বিবিআরএ) গঠিত হওয়ার কথা। এই কর্তৃপক্ষ দালানসংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখভাল করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। অদ্যাবধি সরকার এই কর্তৃপক্ষ গঠনের জন্য কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। এই নীরবতা সুস্পষ্টভাবে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে অবহেলা ও বিধিমালার লঙ্ঘন।

ই–মেইল: [email protected]

দেশে নিরাপদ লিফট উৎপাদন হচ্ছে

ওয়ালটন লিফটের চিফ বিজনেস অফিসার জেনান উল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওয়ালটন থেকে বাংলাদেশের গ্রাহকদের জন্য ইউরোপীয় নিরাপত্তা মান অনুসরণ করে দেশীয় লিফট সরবরাহ করা হচ্ছে। আমরা দেশের বড় বড় শহর থেকে শুরু করে উপজেলা ও গ্রাম পর্যায়ে বিভিন্ন ভবনে লিফট সেবা দিচ্ছি। সারা দেশে এখন আমাদের ১ হাজার ৮০০-এর বেশি লিফট সচল রয়েছে। গ্রাহকের প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিয়ে টেকসই ও শতভাগ নিরাপদ লিফট তৈরি করছি আমরা। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে আমাদের লিফটে কোনো ধরনের দুর্ঘটনার সুযোগ নেই। শতভাগ নিরাপত্তা দিচ্ছে আমাদের তৈরি ওয়ালটন লিফট। বাসাবাড়ি ও অফিসের লিফটের পাশাপাশি কার্গো লিফটও তৈরি করছি আমরা। আমরা শুধু লিফট তৈরির বিষয়কেই গুরুত্ব দিই না, আমরা বিক্রয়–পরবর্তী সেবাকেও গুরুত্ব দিই। লিফট–সংক্রান্ত যেকোনো সমস্যায় আমাদের প্রকৌশলী ও কারিগরেরা দ্রুত সেবা দিতে পারেন। অন্য অনেক ব্র্যান্ডের যন্ত্রাংশের সংকটের কারণে গ্রাহকেরা সমস্যায় পড়েন, স্থানীয়ভাবে লিফট উৎপাদনের কারণে সব সময় আমাদের ইনভেন্টরিতে যথেষ্ট পরিমাণ যন্ত্রাংশের সরবরাহ নিশ্চিত থাকছে।’