অলস পড়ে আছে ৪.৫ লাখ কোটি টাকা

অব্যবহৃত এ অর্থ দিয়ে পদ্মা সেতুর সমান দৈর্ঘ্যের আরও ১৫টি সেতু বানানো সম্ভব।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, ফাইল ছবি

পাবনার ঈশ্বরদীতে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে সরকারের খরচ হচ্ছে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। এ রকম আরও চারটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে লাগতে পারে ৪ লাখ ৫২ হাজার কোটি টাকা। এর প্রায় সমপরিমাণ অর্থ অলস পড়ে আছে, যা বাংলাদেশকে দেবে বলে উন্নয়ন সহযোগীরা প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছে। অব্যবহৃত এ অর্থ দিয়ে পদ্মা সেতুর সমান দৈর্ঘ্যের আরও ১৫টি সেতু বানানো সম্ভব।

উন্নয়ন সহযোগীদের দেওয়া প্রতিশ্রুতির ৫ হাজার ৩৪ কোটি ডলার এখনো অব্যবহৃত অবস্থায়, অর্থাৎ ছাড়ের অপেক্ষায় পাইপলাইনে পড়ে আছে বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকার মতো (প্রতি ডলার ৯০ টাকা ধরে)। প্রতিশ্রুতির এ অর্থ পাওয়ার ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে প্রকল্পের বিপরীতে উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থার সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের ঋণচুক্তি সই হয়েছিল। কিন্তু সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ বিদেশি ঋণের টাকা খরচ করতে পারছে না বলে বিদেশি প্রতিশ্রুতির অর্থ পুরোপুরি ছাড় করা যায়নি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) থেকে গত মাসে প্রকাশিত ‘ফ্লো অব এক্সটারনাল রিসোর্স’ শীর্ষক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে এমন তথ্য মিলেছে।

ইআরডির প্রতিবেদনে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরের তথ্য–উপাত্ত তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি অর্থ অলস পড়ে আছে জাপানের। বাংলাদেশের অন্যতম এই বন্ধু দেশটির প্রতিশ্রুতির ৯৮৭ কোটি ডলার বা ৮৯ হাজার কোটি টাকা পাইপলাইনে রয়ে গেছে।

বর্তমানে জাপানের অর্থায়নে দেশে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কাজ চলছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ঢাকায় মেট্রোরেল, কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র, যমুনা সেতুতে বিকল্প রেললাইন নির্মাণ ইত্যাদি।

দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭৮২ কোটি ডলার বা ৭০ হাজার কোটি টাকার ঋণ অব্যবহৃত পড়ে আছে রাশিয়ার। তৃতীয় অবস্থানে আছে বিশ্বব্যাংকের সহযোগী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (আইডিএ)। তাদের প্রতিশ্রুত অর্থের পরিমাণ ৭৫৫ কোটি ডলার বা ৬৮ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া ভারতের ৬৫৮ কোটি ডলার বা ৫৯ হাজার কোটি টাকা এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ৬০৫ কোটি ডলার বা সাড়ে ৫৪ হাজার কোটি টাকা এখন পাইপলাইনে পড়ে আছে।

উন্নয়ন সহযোগীদের প্রতিশ্রুতির বিপুল পরিমাণ অর্থ পাইপলাইনে আটকে থাকা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে সরকারের একাধিক নীতিনির্ধারক ও বিশেষজ্ঞ কথা বলেছেন। তাঁদের মতে, বিদেশি ঋণের টাকা নয়ছয় করা সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য কঠিন। অন্যদিকে সরকারি টাকা খরচ করা সহজ। বিদেশি ঋণের টাকায় কেনাকাটায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হয়। সরকারি টাকায় ততটা কঠোরভাবে মেনে খরচ করতে হয় না। তাই কর্মকর্তারা সরকারি টাকা খরচেই বেশি মনোযোগ দেন। সে জন্য উন্নয়ন সহযোগীদের প্রতিশ্রুতির টাকা বছরের পর বছর অলস পড়ে থাকে।

ইআরডির প্রতিবেদনমতে, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বাংলাদেশ মোট ১০ হাজার ১৩৬ কোটি ডলার বা ৯ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকার ঋণসহায়তা পেয়েছে। এর মধ্যে ঋণ হিসেবে মিলেছে ৭ হাজার ২৮৪ কোটি ডলার। আর বাকি ২ হাজার ৮৫২ কোটি ডলার পাওয়া গেছে অনুদান হিসেবে।

বিদেশি ঋণের টাকা খরচে বেশ কিছু নিয়মকানুন মানতে হয়। যে কারণে বিদেশি ঋণ খরচে খুব একটা আগ্রহ দেখান না কর্মকর্তারা।
আহসান এইচ মনসুর, নির্বাহী পরিচালক, পিআরআই

এসব বিদেশি ঋণসহায়তার অর্থ সবচেয়ে বেশি খরচ হয়েছে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে। বাকি টাকা পণ্য ও খাদ্য ক্রয় বাবদ খরচ হয়েছে। সবচেয়ে বেশি বিদেশি ঋণ খরচ হয়েছে বিদ্যুৎ খাতে, যা পরিমাণে দেড় হাজার কোটি ডলার বা ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। পরিবহন খাতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলার ও জনপ্রশাসনে তৃতীয় সর্বোচ্চ ১ হাজার ১০০ কোটি ডলার খরচ হয়েছে। এরপর আছে শিক্ষা খাত ৭০০ কোটি ডলার।

বিদেশি ঋণের টাকা কীভাবে অব্যবহৃত থেকে যায়, তার একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বরাদ্দ ছিল ১৮ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা ৩ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা কমিয়ে ১৪ হাজার ৮৩৬ কোটি টাকা করা হয়েছে। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত নির্মাণাধীন মেট্রোরেল প্রকল্পের বরাদ্দ ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা থেকে ৫৬৭ কোটি টাকা কমিয়ে ৪ হাজার ২৩৩ কোটি টাকা করা হয়েছে।

ইআরডির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম দিকে খাদ্য ও পণ্য বাবদ বিদেশিদের কাছ থেকে সহযোগিতা পাওয়া যেত। এখন আর সেই সহযোগিতা আসে না। এখন অর্থায়ন আসছে মূলত প্রকল্পের ভিত্তিতে। ইআরডি কর্মকর্তারা বলছেন, খাদ্য ও পণ্য সহযোগিতা না আসার মানে হলো বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, বিদেশি ঋণ খরচ করতে না পারার মূল কারণ হলো প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যর্থতা। বিদেশি ঋণের টাকা খরচে বেশ কিছু নিয়মকানুন মানতে হয়। যে কারণে বিদেশি ঋণ খরচে খুব একটা আগ্রহ দেখান না কর্মকর্তারা।

আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয়গুলোর কর্মদক্ষতায় মারাত্মক ঘাটতি আছে। সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বাড়লেও প্রশাসনিক সক্ষমতা সে হারে বাড়েনি। তা ছাড়া এখানে ভালো কাজ করলে প্রণোদনা ও খারাপ কাজ করলে শাস্তি প্রদানের কোনো প্রথা নেই। ফলে সবার মধ্যে একধরনের উদাসীনতা কাজ করে।