আর্থিক সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে এজেন্টরা হবেন গেম চেঞ্জার

বাংলাদেশে ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা শুরু হয় ব্যাংক এশিয়ার হাত ধরে। এরপর আরও অনেক ব্যাংক এই সেবা চালু করে। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে শুরু থেকে জড়িত ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরফান আলী। এ সেবার বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক

ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরফান আলী

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা এখন বড় আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। শুরুটা কেমন ছিল?

আরফান আলী: বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আমরা ২০১৩ সালে এই সেবা চালুর আবেদন করি। অনেক দেশে আগে থেকেই এই সেবা ছিল। তবে আমাদের সেবার ধরন কিছুটা ভিন্ন। কারণ, অন্য দেশে এই সেবা দেওয়া হয় পেট্রলপাম্প, মোবাইল রিচার্জ কেন্দ্রসহ বিভিন্ন কেন্দ্রে। বাংলাদেশে এজেন্টরা শুধু ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছেন। সারা বিশ্বে এমন ধরন খুব কম আছে। শুরুর দিকে প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল গ্রাহকের আস্থা অর্জন। গ্রাহকেরা যেখানে টাকা জমা রাখবেন, সেটা ব্যাংকের কোনো শাখা না। এ জন্য আস্থা অর্জনটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। এমনও হয়েছে, কেউ সকালে ৫০০ টাকা জমা দিয়েছেন, আবার বিকেলে তুলে নিয়েছেন। তাঁরা মূলত পরীক্ষা করে দেখেছেন, টাকা জমা দিলে আসলেই ফেরত পাওয়া যায় কি না।

গ্রাহকদের বোঝানোর জন্য এজেন্টদের সঙ্গে ব্যাংকের কর্মীও ছিলেন। পাশাপাশি টাকা জমা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রাহকের মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠানো, ব্যাংক শাখা থেকে টাকা উত্তোলনের সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি আরও নানা সুবিধা দেওয়া হয়। ফলে গ্রাহক সহজেই বুঝে যান, এটা ব্যাংকেরই সেবা। এখন তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ভবিষ্যতে দেশের আর্থিক সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে এজেন্টরাই হবেন গেম চেঞ্জার।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: এজেন্ট ব্যাংকিং সেবায় গ্রাহক কারা হচ্ছেন। তাঁরা কি নতুন গ্রাহক, নাকি ব্যাংকের গ্রাহকেরাই?

আরফান আলী: আমাদের এজেন্ট ব্যাংকিং সেবায় যাঁরা গ্রাহক হয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগ নতুন। এর মধ্যে ৫০ শতাংশের বেশি আগে কখনো ব্যাংকিং সেবা গ্রহণ করেননি। বাকি গ্রাহকেরা বাসার কাছে হওয়ায় বা বিভিন্ন সুবিধার কারণে গ্রাহক হয়েছেন। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হলো, এই সেবায় নারী গ্রাহকের সংখ্যা অনেক। মূলত বাড়ির পাশে সেবা পৌঁছে যাওয়ায় নারীরা গ্রাহক হয়েছেন। দেশের ব্যাংক হিসাবের মধ্যে নারীদের হিসাব ২৫ শতাংশ। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ১ কোটি ২৬ লাখ হিসাবের মধ্যে ৪৬ শতাংশ নারীদের। আর ব্যাংক এশিয়ার ৪৫ লাখ হিসাবের মধ্যে ৬১ শতাংশ নারীদের। নারী হিসাবের ৯৫ শতাংশ গ্রাহকই প্রথমবারের মতো আর্থিক সেবা নিচ্ছেন। এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় ১৮ লাখ সুবিধাভোগীকে ভাতা দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে তাঁরাও এ সেবায় যুক্ত হয়েছেন।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: এজেন্ট ব্যাংকিং কী দেশে কর্মসংস্থান তৈরিতে কোনো ভূমিকা রাখছে?

আরফান আলী: স্বাধীনতার পর এখন পর্যন্ত দেশে প্রায় দুই লাখ ব্যাংকার তৈরি হয়েছে। তবে শুধু এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দেশে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। যাঁরা এজেন্ট হয়েছেন, তাঁরা সেবা দিচ্ছেন, তাঁদের নিজস্ব কর্মী রয়েছে। আবার ব্যাংকের কর্মীরাও এজেন্ট বুথে সেবা দিচ্ছেন। তাঁরা সবাই ব্যাংকিং সেবা দেওয়ার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। পাশাপাশি তাঁদের কর্মসংস্থানও হয়েছে। যাঁরা এজেন্ট হয়েছেন, তাঁদের মধ্য থেকে একটা উদ্যোক্তা শ্রেণি গড়ে উঠেছে। ব্যাংকিং সেবা দেওয়া জনবল যত বাড়বে, মানুষের মধ্যে আর্থিক জ্ঞান তত ছড়াবে। এর সুফল পাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী ও দেশ।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আমানত সংগ্রহে ব্যাংকগুলো বেশ মনোযোগ দিচ্ছে। কিন্তু ঋণ দিচ্ছে না। এজেন্টরা কি শুধু আমানত সংগ্রহই করবে?

আরফান আলী: ব্যাংকগুলো নিজেরা নিজেদের প্রয়োজনেই এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ঋণ দেওয়ায় গুরুত্ব দেবে। কারণ, বড় ঋণে খেলাপি হওয়ার শঙ্কা থাকে বেশি। এ জন্য ছোট ঋণ দেওয়ার প্রতি ব্যাংকের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে এজেন্ট ব্যাংকিং অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠবে। মাত্রই এজেন্টদের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ শুরু হয়েছে, সামনের দিনে তা অনেক বাড়বে। আশা করছি ভবিষ্যতে আমানতের চেয়ে বেশি ঋণ যাবে এজেন্টদের মাধ্যমে। এজেন্টরা সব ধরনের আর্থিক সেবা দেওয়ার মাধ্যম হয়ে উঠবেন।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: ব্যাংক এশিয়া এজেন্টদের পাশাপাশি ডাক বিভাগের মাধ্যমেও সেবা দিচ্ছে? পার্থক্য কী?

আরফান আলী: ডাক বিভাগের কিছু উদ্যোক্তা আছেন, যাঁরা ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারেও বসছেন। আমরা তাঁদের এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দিচ্ছি। ডাক বিভাগের উদ্যোক্তারা প্রশিক্ষিত ও ডাক বিভাগের নিয়ন্ত্রণে। আমরা ডাক বিভাগকে আন্তর্জাতিক ডাকের সঙ্গে সংযুক্ত করে দিয়েছি। ফলে যেকোনো দেশের ডাক বিভাগ থেকে দেশে টাকা পাঠানো যাবে। আমরা সেবাটি আরও সহজ করতে রেমিট্যান্স অ্যাপস চালু করছি। এর ফলে যাঁরা টাকা পাঠাবেন ও যাঁরা গ্রহণ করবেন—উভয়ই উপকৃত হবেন। প্রয়োজনে টাকা পাঠানোর অনুরোধও করা যাবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: মাঝেমধ্যে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে নানা ধরনের অনিয়মও ঘটছে। এতে গ্রাহকেরা শঙ্কিত হয়ে যাচ্ছেন কী?

আরফান আলী: গ্রাহকের টাকা যখন জমা হয়, তাৎক্ষণিক তাঁর মোবাইলে খুদে বার্তা চলে যায়। এ ছাড়া জমা টাকার ওপর বিমা করা থাকে। তাই এই সেবায় খুদে বার্তা গেলেই নিশ্চিত যে টাকা জমা হয়েছে। এই টাকা নিয়ে ভয়ের কোনো কারণ নেই।