ঈদে শতকোটি টাকার ব্যবসা

চট্টগ্রামে হাতে তৈরি ক্ষুদ্র পাদুকাশিল্পের যাত্রা শুরু হয় ১৯৮০ সালের দিকে। কারখানার সংখ্যা ১০ থেকে বেড়ে প্রায় ৪০০টিতে দাঁড়িয়েছে।

ঈদ আসন্ন। কারখানায় কাজ চলবে বড়জোর ২৭ রমজান পর্যন্ত। তাই শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততায় মুখর চট্টগ্রামের হাতে তৈরি জুতার কারখানাগুলো। সম্প্রতি চট্টগ্রাম নগরের পূর্ব মাদারবাড়ী মালুম লেনে
ছবি: জুয়েল শীল

তখন বেলা একটা। কারখানায় রাজ্যের ব্যস্ততা। সমানে চলছে বৈদ্যুতিক সেলাই মেশিন। শ্রমিকেরা কেউ নকশা তৈরি করছেন, কেউবা জুতায় আঠা লাগাচ্ছেন, আর কেউ কেউ জোড়ায় জোড়ায় প্যাকেটে ভরছেন। দম ফেলার ফুরসত নেই কারও।

ঈদ সামনে রেখে সম্প্রতি চট্টগ্রাম নগরের পূর্ব মাদারবাড়ির বেশ কয়েকটি জুতার কারখানায় গিয়ে শ্রমিকদের এ রকম ব্যস্ততা ও কর্মযজ্ঞ দেখা গেছে। এখানকার কারখানাগুলোর বিশেষত্ব হলো, তারা জুতা হাতে তৈরি করে, যা কারখানা থেকে সরাসরি চট্টগ্রামের স্থানীয় বাজার এবং ঢাকা, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় চলে যায়। তবে এখানে জুতার কী পরিমাণ ব্যবসা হয়, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য বা হিসাব নেই। অবশ্য ব্যবসায়ীরা দাবি করেন, শুধু ঈদ উপলক্ষে চট্টগ্রামের কারখানাগুলোয় অন্তত ১০০ কোটি টাকার ব্যবসা হয়। বছরের অন্যান্য সময়ে লেনদেন হয় ১৮ থেকে ২০ কোটি টাকার মতো। কারণ, তাঁদের ব্যবসা মূলত ঈদকেন্দ্রিক।

চট্টগ্রাম নগরের পূর্ব মাদারবাড়িতে ১৯৮০ সালে এই হাতে তৈরি ক্ষুদ্র পাদুকাশিল্পের যাত্রা শুরু হয়। পরে পশ্চিম মাদারবাড়ি, নালাপাড়া, নিউমার্কেট, মোগলটুলি প্রভৃতি এলাকায়ও কারখানা গড়ে ওঠে। বর্তমানে কারখানা আছে প্রায় ৪০০টি। এসব কারখানায় সব মিলিয়ে ১০ হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ করছেন। ১৯৯০ সালে এখানে গঠিত হয় ক্ষুদ্র পাদুকাশিল্প মালিক গ্রুপ।

আলাপকালে সাকসেস সুজ নামের কারখানার মালিক মোহাম্মদ বেলাল প্রথম আলোকে জানান, ১৯৯৯ সালে তিনি পূর্ব মাদারবাড়ি এলাকায় ছোট আকারে জুতার কারখানা গড়েন। বর্তমানে তাঁর কারখানায় কাজ করছেন ১৫ জন। নিজেরা যেমন বিভিন্ন নকশার জুতা তৈরি করেন তেমনি ক্রেতাদের দেওয়া ডিজাইন অনুযায়ীও জুতা বানিয়ে দেন। চট্টগ্রামের টেরিবাজার, নিউমার্কেট, হকার্স ও ফুটপাতের খুচরা ব্যবসায়ীরাই মূলত তাঁদের কাছ থেকে জুতা কিনে নেন।

মোহাম্মদ বেলাল জানান, এবার ঈদ সামনে রেখে তাঁরা ২০ রকমের জুতা তৈরি করেছেন। দাম শুরু হয় প্রতি ডজন ২ হাজার টাকা থেকে।

অন্য কয়েকটি কারখানার মালিক বলেছেন, ঈদের মৌসুমে চাঙা হয় হাতে তৈরি জুতার ব্যবসা। গত দুটি ঈদ মৌসুমে করোনার কারণে ব্যবসা করা যায়নি। তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। ঈদের আগে পয়লা বৈশাখ তথা বাংলা নববর্ষ উৎসব এসে যাওয়ায় জুতার বিক্রির বাড়তি সুযোগ মিলেছে। এককথায়, জুতার ব্যবসা করোনার ধকল কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে।

অবশ্য কারখানার মালিকদের আপত্তি ও অভিযোগ রয়েছে, ভারত ও চীন থেকে দেদার জুতা আসছে। করোনার ধকলের ওপর চীন–ভারতের জুতা আসায় ব্যবসায়ে টিকে থাকতে বেশ হিমশিম খেতে হয়েছে বলে জানান তাঁরা। কারখানার মালিকদের ভাষ্য, ভারতীয় ও চীনা জুতার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই তাঁদের টিকে থাকতে হচ্ছে। আগে অবস্থা এত খারাপ ছিল না।

সরেজমিনে দেখা যায়, কোনো কোনো কারখানার আয়তন ২০ ফুট বাই ১০ ফুট। আবার কোনোটি একটু বড়, অর্থাৎ ৩০ ফুট বাই ১৫ ফুট। এসব কারখানার ভেতরে কাঠের পাটাতন দিয়ে দোতলা করে দেওয়া হয়েছে। শ্রমিকেরা ওপরে–নিচে বসেই যে যাঁর মতো করে জুতায় আঠা লাগান, তলানি কাটেন, ফিতা বাঁধেন, সেলাই করেন এবং প্যাকেটে ভরেন।

কাজের ফাঁকে ফাঁকে কারখানার মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখানার কারখানাগুলোয় মূলত ছেলেদের স্যান্ডেল, শু, স্লিপার, স্নিকার ও হাফ সুজের পাশাপাশি নারীদের হিল, স্যান্ডেল, শু ইত্যাদি তৈরি হয়।

ব্যবসায়ীরা প্রথম আলোকে জানান, জুতা তৈরিতে ফিতা, আঠা, ফোম, রেক্সিনসহ যেসব কাঁচামালের প্রয়োজন হয়, তার বেশির ভাগই আসে ভারত ও চীন থেকে। করোনার পর চীন ও ভারতে প্রায় প্রতিটি কাঁচামালের দাম বেড়েছে। এ কারণে তাঁদের জুতার দাম বাড়াতে হয়েছে।

জুতা বিক্রির পরিমাণ সম্পর্কে চট্টগ্রাম ক্ষুদ্র পাদুকাশিল্প গ্রুপের সভাপতি মনজুর খান বলেন, ঈদ মৌসুমে প্রায় ১০০ কোটি টাকার ব্যবসা হয়। কিন্তু করোনার কারণে গতবার তা হয়নি। করোনা ব্যবসা একেবারে থামিয়ে দেয়। তিনি আরও বলেন, সরকার এসএমই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ৪ কোটি টাকা প্রণোদনা দিয়েছে, যা পেয়েছেন মাত্র ৭০ জনের মতো কারখানা মালিক। অথচ এখানে কারখানা আছে প্রায় ৪০০।

করোনায় বন্ধ হয়েছে ২৫ কারখানা

করোনা মহামারির শুরুতে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা ধাক্কা খেয়েছেন। টিকে থাকতে অনেকেই জনবল ছাঁটাই করেন। অনেকে প্রতিষ্ঠানই বন্ধ করে দেন। করোনার দুই বছরে ২৫টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে কয়েক বছর আগে ব্যবসা শুরু করা ব্যক্তিরা যেমন আছেন তেমনি রয়েছেন দুই–তিন দশকের পুরোনো কারখানার মালিকও। যেমন, সন্ধান সুজ। ১৯৯২ সালে যাত্রা শুরু করা এই প্রতিষ্ঠানের মালিক এ বি সিদ্দিক জানান, তাঁর প্রতিষ্ঠানে ২৫ জনের মতো শ্রমিক ছিলেন। করোনার প্রথম বছর কোনোভাবে পার করলেও পরের বছর আর টানতে পারেননি।

আমির আহমেদ নামের আরেক ব্যবসায়ী জানান, তিনিও ১৯৯২ সালে ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু ২৮–২৯ বছর পরে এসে করোনার ধাক্কায় তিনি ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন।