একজন অর্থনীতিবিদের চোখে দিলীপ কুমার
যেকোনো সংজ্ঞায় দিলীপ কুমার হলেন কিংবদন্তি। আজ এই কিংবদন্তি বিদায় নিয়েছেন। তবে দিলীপ কুমারের মতো এমন একজনকে নিয়ে লেখালিখি নেহাতই হাতে গোনা। এর মধ্যে অন্যতম বলা যায় ‘নেহরুজ হিরো দিলীপ কুমার, ইন দ্য লাইফ অব ইন্ডিয়া’ বইটি। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের বড় অর্থনীতিবিদ লর্ড মেঘনাদ জগদীশচন্দ্র দেশাই সামাজিক বাস্তবতার সমতুল্য করে তাঁকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন।
দিলীপ কুমারের ২০ বছরের কর্মজীবন নিয়ে এই অর্থনীতিবিদ লিখেছিলেন বইটি। বলা যায়, দিলীপ কুমারকে নিয়ে যত লেখা আছে, লর্ড মেঘনাদ দেশাইয়ের লেখাটা তার মধ্যে সবচেয়ে ব্যতিক্রম। কারণ, একজন অর্থনীতিবিদের কলমে বইটি হলো রাজনীতির সঙ্গে সিনেমার এক সংমিশ্রণ। এ যেন তুলে ধরে কীভাবে শাসনের সঙ্গে অসম্পৃক্ত, অ-একাডেমিক একটি বিষয় রাজনীতির পথে প্রভাব ফেলে।
চলচ্চিত্রের ভূমিকা কীভাবে পরিবর্তিত হয়, জীবনের সামাজিক দিকটি কীভাবে ভারতকে তুলে ধরে, পুরুষত্বের আদর্শ, আপনার নায়ক কেমন হওয়া উচিত—এ বিষয়গুলো যেন দিলীপ কুমারকে দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছিলেন লেখক। কারণ, মেঘনাথ দেশাইয়ের চোখে দিলীপ কুমার ছিলেন আইকন। ছোটবেলা থেকেই দিলীপ কুমারের মতো হতে চাইতেন তিনি।
তিনি একবার লিখেছেন, ‘আমরা তাঁর চুলের স্টাইল, পোশাক, সংলাপ ও আচরণ সবকিছু অনুকরণ করতাম। পর্দায় তাঁর চরিত্রটা আমরা আত্মস্থ করার চেষ্টা করতাম।’ তাই তো এই আইকনকে দিয়েই সিনেমার জগৎকে রাজনীতির মধ্যে মিলিয়েছিলেন লেখক। তাঁর সিনেমার প্রভাব কতটা ছিল সমাজে, সেটিই তুলে ধরতে চেয়েছেন।
মেঘনাদ দেশাই তাঁর বইতে লেখেন, দিলীপ কুমারকে ঘিরে ভারত বদলে যাচ্ছিল। যে ভারত ছিল জওহরলাল নেহরুর ভারত। দিলীপ কুমার ছিলেন নেহরুভিয়ান মানুষের সংবেদনশীল, শক্তিশালী, আবেগপ্রবণ অথচ মননশীল, একজন রোল মডেল, আইকন এবং সর্বদা অনুকরণীয় চরিত্র। মূলত ১৯৪৪ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত দিলীপ কুমারের সিনেমাগুলো নিয়ে বইটি লেখা হয়। এ সময়ে ৫৭টি সিনেমায় অভিনয় করেন দিলীপ কুমার। বলে রাখা প্রয়োজন, দিলীপ কুমার তাঁর ছয় দশকের ক্যারিয়ারে মাত্র ৬৩টি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। অর্থাৎ, এই বিশ বছরেই ক্যারিয়ারের সিংহভাগ সিনেমায় অভিনয় করেন দিলীপ কুমার। আসলে বোম্বের শেরিফ, পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ, দাদাসাহেব ফালকেসহ অগণিত পুরস্কার পাওয়া, বিতর্কিতভাবে রাজ্যসভার সদস্যপদ লাভ করা, পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে নিশান-ই-ইমতিয়াজ দিলীপ কুমার ছিলেন প্রকৃতপক্ষে নেহরুর নায়ক।
দেশ বিভাগের পর ১৯৫০–এর দশকে বিশ্ব মঞ্চের এক আত্মবিশ্বাসী খেলোয়াড় হিসেবে পরিবর্তিত হচ্ছিল ভারত। তবে ১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধের সময় হোঁচট খায় দেশটি—দিলীপ কুমারের অভিনীত চরিত্র দিয়ে এই রূপান্তরগুলোই পাঠককে বুঝিয়েছেন লর্ড মেঘনাথ দেশাই। এই সময়ে দিলীপ কুমারের চারটি চলচ্চিত্র, ‘ফুটপাত’, ‘নয়া দৌড়’, ‘গঙ্গা যমুনা’ ও ‘লিডার’ যেন ভারতের চলমান অবস্থারই চিত্র ছিল।
এর মধ্যে বি আর চোপড়ার ‘নয়া দৌড়’ (১৯৫৭) পুরোপুরিই নেহরুভিয়ান চলচ্চিত্র। ২০ বছরের এই সময়ে দিলীপ কুমারের এটি সবচেয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সমসাময়িক চলচ্চিত্র। এই ছবিতে টাঙ্গাওয়ালা শংকরের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন দিলীপ কুমার। সিনেমাটি সে সময়ে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও গ্রামীণ সম্প্রদায়ের উন্নয়নের জন্য নেওয়া নতুন উদ্যোগের সঙ্গে পুরোপুরি একাত্মতা প্রকাশ করে। ‘গঙ্গা যমুনা’ (১৯৬১)। এটা ছিল নীতিন বোসের ছবি। সামন্ততান্ত্রিক গ্রামীণ সমাজের অত্যাচারে ছবির নায়ক ডাকাত বনে যাচ্ছে। প্রতিটি ছবিরই তীব্র প্রভাব ছিল সমাজে। আর অর্থনীতিবিদ মেঘনাথ দেশাই দিলীপ কুমারের প্রভাব দিয়ে পুরো ভারতেরই চিত্র তুলে ধরেন।
লেখক তাঁর আইকন দিলীপ কুমারের ক্যারিয়ারকে এমনভাবে দেখেছেন, যা ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনেরই এক প্রতিবিম্ব।