করোনায় আয় কমেছে ৬২% শ্রমিকের

মূলত ২০২০ সালের মার্চ-ডিসেম্বর সময়ে শ্রমবাজারে কী প্রভাব পড়ল, তা নিরূপণে এই জরিপ করা হয়েছে।

ফাইল ছবি

কোভিডের প্রভাবে কর্মজীবী মানুষের আয় কমেছে। অনেকে কাজ হারিয়েছেন। সাধারণ ছুটির মধ্যে শ্রমজীবী মানুষের বড় একটি অংশ গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হন। তবে তাঁদের বেশির ভাগই ২০২০ সালের শেষ নাগাদ শহরে ফিরে এসেছেন।

বেতন বা মজুরির বিনিময়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের মধ্যে ৬২ শতাংশ কর্মী বা শ্রমিক বলেছেন, ২০২০ সালের মার্চ-ডিসেম্বর সময়ে তাঁদের মজুরি বা বেতন ২০১৯ সালের তুলনায় কমে গেছে। ৭ দশমিক ৯ শতাংশ এই সময়ে কাজ হারিয়েছেন। একই পরিমাণ শ্রমিক এখনো (জরিপ চলাকালে) কাজ ফিরে পাননি। তবে সে ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা বেশি। কর্মসংস্থান ও অভিবাসনে কোভিড-১৯-এর প্রভাব নিরূপণে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের এক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল এক ভার্চ্যুয়াল অনুষ্ঠানে জরিপের তথ্য প্রকাশ করেছে তারা।

মূলত ২০২০ সালের মার্চ-ডিসেম্বর সময়ে শ্রমবাজারে কী প্রভাব পড়ল, তা নিরূপণে এই জরিপ পরিচালনা করা হয়েছে বলে জানান সানেমের গবেষণা পরিচালক সায়েমা হক। তিনি জানান, ৪৯ শতাংশ কর্মজীবী ২০২০ সালের মার্চ-ডিসেম্বর সময়ের মধ্যে চাকরি হারানো, বেতন না পাওয়া বা কম বেতন পাওয়া, বাসা ভাড়া ও অন্যান্য ব্যয় নির্বাহ করতে না পারা ইত্যাদি কারণে শহর থেকে গ্রামে চলে গিয়েছিলেন। মূলত দক্ষতানির্ভর পেশায় তাঁরা নিয়োজিত ছিলেন। তবে এই ৪৯ শতাংশ কর্মজীবীর প্রায় সবাই আবার শহরে ফিরে কাজে যোগ দিয়েছেন বা কাজ খুঁজতে এসেছেন।

জরিপে আরও জানা গেছে, ২০ শতাংশ প্রবাসী শ্রমিক ২০২০ সালের মার্চ-ডিসেম্বর সময়ের মধ্যে কাজ হারিয়েছেন। প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে ৫ শতাংশ বিভিন্ন কারণে দেশে ফিরে এসেছেন। ১ দশমিক ৭ শতাংশ জানিয়েছেন, তাঁরা ২০২০ সালের মার্চ-ডিসেম্বর মাসে সাময়িকভাবে কাজ হারিয়েছিলেন।

এই প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, গ্রাম থেকে মানুষ কাজের সন্ধানে শহরে আসবে, সেটাই স্বাভাবিক। গ্রামে তাদের কর্মসংস্থান হবে না। শহরে আসতেই হবে। সে জন্য এখন বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। নতুন বিনিয়োগ না হলে এই মানুষদের কীভাবে জায়গা দেওয়া সম্ভব। বেকারত্ব এমনিতেই বড় সমস্যা। তার সঙ্গে নতুন আরও মানুষ শহরে আসবে। ফলে অর্থনীতিতে বড় চাপ পড়বে।

জরিপে আরও জানা গেছে, ২০ শতাংশ প্রবাসী শ্রমিক ২০২০ সালের মার্চ-ডিসেম্বর সময়ের মধ্যে কাজ হারিয়েছেন। প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে ৫ শতাংশ বিভিন্ন কারণে দেশে ফিরে এসেছেন। ১ দশমিক ৭ শতাংশ জানিয়েছেন, তাঁরা ২০২০ সালের মার্চ-ডিসেম্বর মাসে সাময়িকভাবে কাজ হারিয়েছিলেন। ৫ দশমিক ৪ শতাংশ জানিয়েছেন, তাঁরা পেশা পরিবর্তন করেছেন।

মহামারির আগে থেকেই বেসরকারি বিনিয়োগ, বিদেশি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের পরিস্থিতি ভালো ছিল না। কোভিড-১৯-এর অভিঘাতে এসব সমস্যা আরও তীব্র হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান মনে করেন, সরকারের গৃহীত নীতি শুধু পণ্য ও সেবা বাজারকেন্দ্রিক। পুঁজিবাজার বা শ্রমবাজারের পুনরুদ্ধারের জন্য নীতি নেই বললেই চলে, থাকলেও তেমন দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়। পণ্য ও সেবা এবং পুঁজি ও শ্রমবাজার একই সঙ্গে গুরুত্ব না পেলে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া তেমন একটা গতি পাবে না। তাঁর পরামর্শ, নীতি প্রণয়নের সময় অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের বিশাল কর্মী বাহিনীর কথাও মাথায় রাখতে হবে।

জরিপের বিভিন্ন খাত, অঞ্চল, নারী-পুরুষ, কাজের ধরনভিত্তিক তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। আলোচকেরা এই দিকটির প্রশংসা করেন। দেখা গেছে, জাতীয় পর্যায়ে এখনো ৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ মজুরি শ্রমিক কাজ হারানোর পর এখনো কাজে ফিরতে পারেননি। এর মধ্যে শহরাঞ্চলের শ্রমিকের অনুপাত ৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ এবং গ্রামাঞ্চলের ৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ।বিভাগওয়ারি তথ্যে দেখা যায়, এখনো কাজে ফিরতে না পারা শ্রমিকের সংখ্যা বরিশালে সর্বাধিক—১২ দশমিক ৯৪ শতাংশ। সর্বনিম্ন খুলনায় ৩ দশমিক ২৩ শতাংশ, যেখানে ঢাকায় তা ৭ দশমিক ৭১ শতাংশ।

করণীয়

এই পরিস্থিতিতে সানেমের পরামর্শ, যেসব খাত (নির্মাণ, যোগাযোগ, হোটেল, রেস্তোরাঁ) এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি, সেগুলো চিহ্নিত করে ন্যূনতম শর্তে প্রণোদনা দিতে হবে। স্বকর্মসংস্থানে নিয়োজিত ব্যক্তিরা এখনো ঘুরে দাঁড়াতে না পারায় তাঁদের সব ধরনের নীতির কেন্দ্রে রাখতে হবে। শহরাঞ্চলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা।

ওয়েবিনারের বিশেষ অতিথি ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) বাংলাদেশের প্রধান টুমো পটিআইনেন এ প্রসঙ্গে বলেন, কয়েকটি খাতে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া দরকার। মানুষ কাজে ফিরলেও কর্মঘণ্টা কমে যাচ্ছে কি না, দেখতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে প্রণোদনা প্যাকেজ পাওয়া কঠিন বলে উল্লেখ করে তিনি এ ব্যাপারে বিশেষ নীতি গ্রহণে জোর দেন।

অনুষ্ঠানে অংশ নেন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার তাসনিম সিদ্দিকী এবং সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।