করোনায় বড় প্রতিষ্ঠানের ভালো ব্যবসা

গত জুলাই-এপ্রিল সময়ে এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) আগের বছরের চেয়ে সাড়ে ১৬ শতাংশ বেশি ভ্যাট আদায় করেছে।

করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার গত এক বছরে চলাচলে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। চলাচল সীমিত হওয়ায় পারস্পরিক যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হয়ে ওঠে মোবাইল ফোন বা মুঠোফোন। ফোনে কথা বলা যেমন বেড়েছে, তেমনি ইন্টারনেটের ব্যবহারও বেড়েছে। চলাচলে বাধা থাকায় করোনাকালে ‘ভিডিও কলও’ জনপ্রিয় হয়েছে। আবার শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্লাসরুমের বদলে মোবাইলে বা ইন্টারনেট ব্যবহার করে অনলাইন ক্লাস করেছেন।

এসব কারণে করোনাকালে মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলোর ব্যবসা বেড়েছে। ফলে মুঠোফোন অপারেটরদের কাছ থেকে ভ্যাট, সম্পূরক শুল্কসহ নানা ধরনের শুল্ক-করও আগের চেয়ে বেশি পেয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক ও টেলিটক—দেশের এই চারটি মোবাইল ফোন অপারেটর এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিটে (এলটিইউ) তালিকাভুক্ত। এ চার অপারেটর থেকে চলতি ২০২০–২১ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ৭ হাজার ৮৬ কোটি টাকা ভ্যাট পাওয়া গেছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে দেড় হাজার কোটি টাকা বা ২৮ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরে ভ্যাট পাওয়া গিয়েছিল ৫ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি ৩ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা ভ্যাট দিয়েছে গ্রামীণফোন।

শুধু মোবাইল ফোন নয়; করোনাকালে দেশের বড় বড় খাতের বড় কোম্পানিগুলো ভালো ব্যবসা করেছে। ভালো ব্যবসা করে এসব কোম্পানি সরকারি কোষাগারে আগের বছরের চেয়ে শুল্ক-করও বেশি দিয়েছে। করোনার বছরে ভালো ব্যবসা করা বড় খাতগুলোর মধ্যে আছে সিগারেট, মোবাইল ফোন, ওষুধ, সিমেন্ট, ব্যাংক ও আর্থিক খাত, খাদ্য ও খাদ্যজাত পণ্য এবং পানীয় খাত। ভ্যাট আদায়ের তথ্য বলছে, এসব খাতের বড় বড় কোম্পানি আগের চেয়ে বেশি ব্যবসা করে বেশি ভ্যাট দিয়েছে সরকারকে।

এনবিআরের ভ্যাটের বৃহৎ করদাতা ইউনিটের গত এপ্রিল মাস পর্যন্ত ভ্যাট আদায় পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে এ চিত্র পাওয়া গেছে। এলটিইউতে দেশের বিভিন্ন খাতের ১১০টি বড় কোম্পানি তালিকাভুক্ত আছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে কোম্পানিগুলো সব মিলিয়ে ৪১ হাজার ৫০ কোটি টাকা ভ্যাট দিয়েছে। এই করোনাকালেও বড় কোম্পানিগুলো গতবারের চেয়ে সাড়ে ১৬ শতাংশের বেশি ভ্যাট দিয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে বড় কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ৩৫ হাজার ২০৩ কোটি টাকার ভ্যাট আদায় করেছিল এলটিইউ।

জানতে চাইলে এলটিইউর কমিশনার ওয়াহিদা রহমান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এই করোনার মধ্যে এলটিইউতে ভ্যাট ও করের জন্য নিবন্ধিত কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ভ্যাট আদায়ে ১৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি আছে। এলটিইউ থেকে ৩৪টি প্রতিষ্ঠান বাদ দেওয়ার পরও ভ্যাট আদায়ে এই প্রবৃদ্ধি বেশ ইতিবাচক। তিনি আশা প্রকাশ করেন, চলতি অর্থবছরে এলটিইউর ভ্যাট আদায় ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এর আগে কখনো এই মাইলফলক অতিক্রম করতে পারেনি এলটিইউ।

করোনার মধ্যে এলটিইউতে নিবন্ধিত কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ভ্যাট আদায়ে ১৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি আছে। এলটিইউ থেকে ৩৪টি প্রতিষ্ঠান বাদ দেওয়ার পরও এই প্রবৃদ্ধি বেশ ইতিবাচক।
ওয়াহিদা রহমান চৌধুরী, কমিশনার, এলটিইউ

সিগারেটে প্রবৃদ্ধি ১৮%

করোনাকালে সিগারেটের ব্যবসাও বেড়েছে—এমন ইঙ্গিত দিচ্ছে রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি। ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো ও ইউনাইটেড ঢাকা টোব্যাকো—দেশের বড় দুটি সিগারেট প্রস্তুত ও বাজারজাতকারী কোম্পানি এলটিইউতে তালিকাভুক্ত। জুলাই-এপ্রিল ১০ মাসে কোম্পানি দুটি আগের চেয়ে ১৮ শতাংশ বেশি ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক দিয়েছে। এ সময়ে কোম্পানি দুটি ২২ হাজার ৬১১ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বেশি।

ব্যাংকিং সীমিত, তবু ভ্যাট বেড়েছে

ব্যাংকে আপনার একটি হিসাব আছে। এক বছরে নির্দিষ্ট অঙ্কের বেশি টাকা থাকলে ব্যাংক আবগারি শুল্ক কেটে রাখে। এ ছাড়া ব্যাংক হিসাব সংরক্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা দিয়ে থাকে। এসব সেবার বিপরীতে ভ্যাট কেটে রাখা হয়। করোনার সময়ে ব্যাংকিংয়ের সময় কমিয়ে আনা হয়েছে, কিন্তু ভ্যাট আদায় বেড়েছে। এর মানে, ব্যাংকগুলোতে মানুষ বেশি সেবা নিয়েছে। এলটিইউতে ১৭টি ব্যাংক তালিকাভুক্ত আছে। এই ব্যাংকগুলো গত ১০ মাসে ২ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা ভ্যাট, আবগারি শুল্কসহ নানা ধরনের শুল্ক-কর দিয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪২ শতাংশ বেশি। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক গত ১০ মাসে ৫২৩ কোটি টাকা ভ্যাট দিয়ে এই খাতে শীর্ষ স্থানে আছে। আগেরবারের চেয়ে প্রায় চার গুণ বেশি রাজস্ব দিয়েছে ব্যাংকটি।

জানতে চাইলে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক (এসসিবি) বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নাসের এজাজ বিজয় প্রথম আলোকে বলেন, ‘গতানুগতিক ব্যাংকিংয়ের বাইরে আমরা দুটি চুক্তি করেছি। একটি হলো সরাসরি ভ্যাট পরিশোধে সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি এবং অপরটি হলো আমদানির ক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক তহবিল স্থানান্তর। এর ফলে ভ্যাটের পরিমাণ বেড়েছে। এ ছাড়া বিদেশ থেকে কারিগরি সহায়তা ফির কিছু ভ্যাট বকেয়া ছিল, তা–ই পরিশোধ করা হয়েছে।’

ওষুধ কোম্পানির ব্যবসা ভালো

করোনাকালে ওষুধ কোম্পানির ব্যবসা ভালো হয়েছে—এটা মোটামুটি সবারই জানা। দেশের বড় ২৪টি ওষুধ কোম্পানি এলটিইউতে তালিকাভুক্ত। এই কোম্পানিগুলো ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৯৬ কোটি টাকা বেশি ভ্যাট দিয়েছে। এবার ২ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা ভ্যাট দিয়েছে এলটিইউতে নিবন্ধিত ২৪টি ওষুধ কোম্পানি। এগুলোর মধ্যে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস সবচেয়ে বেশি ৪২৯ কোটি টাকা ভ্যাট দিয়েছে।

অন্যান্য

করোনায় কোমল পানীয়র ব্যবসাও যে জমজমাট ছিল—রাজস্ব আদায়ের চিত্র সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে। দেশের শীর্ষ চারটি কোমল পানীয় প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান গত জুলাই-এপ্রিল সময়ে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১১২ কোটি টাকা বেশি ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক দিয়েছে। এলটিইউর তথ্য অনুযায়ী, ওই চারটি প্রতিষ্ঠান প্রায় ৫০০ কোটি টাকা শুল্ক-কর দিয়েছে।

নির্মাণ খাতের অন্যতম অনুষঙ্গ সিমেন্ট। তথ্য বলছে, সিমেন্ট উৎপাদন খাতও চাঙা ছিল। একইভাবে সিরামিকস খাতের চারটি কোম্পানি আগের চেয়ে ৫০ কোটি টাকা বা ২৬ শতাংশ বেশি ভ্যাট দিয়েছে।

হোটেল ব্যবসায় ধস

করোনার সময়ে বেশ খারাপ করেছে হোটেল ব্যবসা। করোনার কারণে একটা লম্বা সময় হোটেলগুলো প্রায় বন্ধই ছিল। প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও, ইন্টারকন্টিনেন্টাল ঢাকা, র‍্যাডিসন ব্লু ওয়াটার গার্ডেন, ঢাকা রিজেন্সি ও ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট (ওয়েস্টিন হোটেল)—দেশের এ পাঁচটি তারকা হোটেল এলটিইউর করদাতা। ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত কক্ষভাড়া, রেস্টুরেন্ট, বার, লন্ড্রিসহ বিভিন্ন সেবায় ৮৯ কোটি টাকার ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক দিয়েছিল এ হোটেলগুলো। কিন্তু গত ১০ মাসে তা অর্ধেকের নিচে নেমেছে। গত জুলাই-এপ্রিল সময়ে পাঁচটি হোটেল মিলে মাত্র ৩৭ কোটি টাকা ভ্যাট দিয়েছে।