খরচ বেশি, সময়ও লাগে অনেক

সক্ষমতার বড় অংশই অব্যবহৃত থাকছে পানগাঁও টার্মিনালে। কারণ পণ্য পরিবহনে বাড়তি খরচ ও বেশি সময় লাগে। সম্প্রতি পানগাঁওয়ের ডকইয়ার্ড এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

কনটেইনার টার্মিনাল বলতে চোখের সামনে ভেসে ওঠে কর্মচঞ্চল এক পরিবেশ। ক্রেনের সাহায্যে জাহাজ থেকে টার্মিনালে আর টার্মিনাল থেকে জাহাজে কনটেইনার ওঠানো-নামানো, শ্রমিক-কর্মচারীর হাঁকডাক, কনটেইনারবাহী গাড়ির আসা-যাওয়াসহ আরও কত কী! কিন্তু এসবের তেমন কিছুই নেই ঢাকার অদূরে বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা কেরানীগঞ্জের পানগাঁও ইনল্যান্ড কনটেইনার টার্মিনালে (পিআইসিটি)।

সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে পানগাঁও নৌ টার্মিনালটি অনেকটা ফাঁকাই দেখা গেল। টার্মিনালের ভেতরে শ খানেক কনটেইনার দেখা গেল। কনটেইনার রাখার জন্য এ টার্মিনালে ৫৫ হাজার বর্গমিটার চত্বর আছে, তার মাত্র ৩-৪ শতাংশ জায়গা ব্যবহৃত হচ্ছে। ১৮০ মিটার লম্বা জেটিও প্রায় ফাঁকা।

সাত বছর আগে পানগাঁও কনটেইনার টার্মিনাল চালু হলেও এখনো আমদানি-রপ্তানিকারকেরা এটি খুব একটা ব্যবহার করছেন না। ২০২০ সালে এই টার্মিনাল দিয়ে সাড়ে ২০ হাজার একক কনটেইনার ওঠানো-নামানো হয়েছে। এটি টার্মিনালের কনটেইনার ওঠানো-নামানোর বার্ষিক ক্ষমতার মাত্র ১৮ শতাংশ। গত বছর সব মিলিয়ে ১৪৮টি জাহাজ ভিড়েছে।

সময় ও খরচ বেশি

বিদেশি ক্রেতাদের প্রতিনিধি, রপ্তানিকারক ও আমদানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিদিন জাহাজ চলাচল না থাকায় পানগাঁও টার্মিনাল দিয়ে পণ্য আমদানি বা রপ্তানিতে সময় বেশি লাগে। ব্যবহারকারীদের এ অভিযোগের সত্যতা মিলে টার্মিনালটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেও। তাঁরা জানান, সপ্তাহের ঠিক কোন দিন কখন এখানে জাহাজ ভিড়বে, তা নিশ্চিত নয়। এক দিনে একাধিক জাহাজ এল তো এক সপ্তাহে আবার একটি।

আমদানিকারকেরা বলছেন, বিদেশ থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে কোনো পণ্য নামানোর পর পানগাঁওমুখী জাহাজে তোলার জন্য দু-তিন দিন অপেক্ষা করতে হয়। এরপর জাহাজে করে পানগাঁও টার্মিনালে এনে সেখান থেকে আবার ট্রাকে করে পণ্য কারখানায় বা গুদামে নিতে হয়। সব মিলিয়ে কয়েক দিন লেগে যায়। অন্যদিকে রেলপথে ও সড়কপথে সময় লাগে কম। চট্টগ্রাম-পানগাঁও নৌপথে জাহাজ পরিচালনাকারীরা বলছেন, কনটেইনারের চাপ না থাকায় প্রতিদিন জাহাজ চালানো যাচ্ছে না।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক বলেন, ব্যবসায়ীরা যদি পানগাঁও কনটেইনার টার্মিনাল দিয়ে পণ্য আনতে চান, তাহলে কনটেইনারের চাপ বাড়বে। তাতে চট্টগ্রাম-পানগাঁও নৌপথে প্রতিদিন জাহাজ চলাচল করবে। এখন পানগাঁওমুখী কনটেইনার কম থাকায় জাহাজ প্রতিদিন চালাচ্ছেন না জাহাজমালিকেরা।

সময়ের পাশাপাশি পানগাঁওয়ে খরচও বেশি। তাই চট্টগ্রাম বন্দরের চার সদস্যের একটি কমিটি গত বছরের জানুয়ারিতে মাশুল পুনর্বিন্যাসবিষয়ক এক প্রতিবেদনে সেটি উল্লেখও করেছে। এর একটি উদাহরণ এ রকম, মাশুল ছাড় দেওয়ার পরও একেকটি আমদানি পণ্যবাহী বড় কনটেইনার (৪০ ফুট লম্বা) চট্টগ্রাম থেকে জাহাজে তোলা ও পানগাঁও নৌ টার্মিনালে নামানোসহ খরচ দাঁড়ায় ১০ হাজার ২৮৪ টাকা। অথচ একই ধরনের কনটেইনার রেলপথে কমলাপুর ডিপোতে আনলে খরচ হয় ৪ হাজার ৫৬০ টাকা। অর্থাৎ রেলপথে কমলাপুর আনার চেয়ে নৌপথে পানগাঁওয়ে আনলে প্রতি কনটেইনারে ৫ হাজার ৭২৩ টাকা বেশি খরচ হয়। এ জন্য ওই কমিটি মাশুল পুনর্বিন্যাসের সুপারিশ করেছিল। কিন্তু তা কার্যকর হয়নি।

টার্মিনালটির ব্যবহার প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিট পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, এ জন্য তিনটি পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত, প্রতিদিন চট্টগ্রাম বন্দর-পানগাঁও রুটে জাহাজ চলাচল থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিদেশি ক্রেতারা যাতে এই টার্মিনাল থেকে পণ্য নেয়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। তৃতীয়ত, এখন যে মাশুল রয়েছে, তা কমাতে হবে। তাহলেই পানগাঁওয়ের ব্যবহার বাড়বে।

টিকে আছে ওরা ১১ জন

আমদানিকারকদের প্রতিনিধি হিসেবে মাঠপর্যায়ে পণ্য খালাস করে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট, আর রপ্তানি পণ্য বিদেশি ক্রেতাদের হাতে তুলে দেওয়ার যাবতীয় কাজ করে দেয় ফ্রেইট ফরোয়ার্ডাররা। পানগাঁও টার্মিনালে কনটেইনার পরিবহন কম হওয়ায় এই দুই ধরনের প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের ব্যস্ততা নেই। টার্মিনালটি চালু হওয়ার সময়ে পানগাঁও কাস্টমস স্টেশনে প্রায় ৩৫০টি সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স নিলেও বর্তমানে সক্রিয় আছে মাত্র ১১টি।

সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান ফিল্মফেয়ার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাদল চৌধুরী বলেন, এই টার্মিনালে প্রতি টন পণ্য খালাসে ১৫ ডলার করে বেশি খরচ হচ্ছে। তাই টার্মিনালটি ব্যবহারে ব্যবসায়ীদের আগ্রহ নেই।

পানগাঁও পাচ্ছে ১ শতাংশের কম

চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর এই বন্দর দিয়ে আমদানি হওয়া পণ্যের মাত্র দশমিক ৮০ শতাংশ নৌপথে পানগাঁও এনে খালাস হয়েছে। রেলপথে ঢাকার কমলাপুর অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপোতে (আইসিডি) এসেছে ৩ শতাংশ। বাকি সব পণ্যই সড়কপথে পরিবহন হয়েছে। একইভাবে রপ্তানি পণ্যের মাত্র শূন্য দশমিক ১ শতাংশ পানগাঁও টার্মিনাল দিয়ে নৌপথে চট্টগ্রাম বন্দরে নেওয়া হয়েছে। রেলপথে চট্টগ্রামে নেওয়া হয়েছে সাড়ে ৩ শতাংশ। বাকি সব পণ্য সড়কপথে চট্টগ্রাম বন্দরে নেওয়া হয়েছে।

ব্যবহারকারীরা বলছেন, পানগাঁও কনটেইনার টার্মিনালের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে পারলে সড়কপথের ওপর চাপ কমবে। তবে এ জন্য তাঁদের দাবি হলো, পানগাঁও টার্মিনালের মাশুল কমানোর পাশাপাশি প্রতিদিন জাহাজ চলাচল নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নিতে হবে।