নাগরিক প্ল্যাটফর্মের সংলাপ
টাকার রং বদলে লাভ নাকি ক্ষতি, নানা জনের নানা মত
এসডিজি বাস্তবায়নে গঠিত নাগরিক প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন।
২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে প্রায় ১০,২২০ কোটি টাকা সাদা হয়েছে।
৭ হাজার ৪৪৫ জন করদাতা প্রায় ৯৫০ কোটি টাকা কর দিয়ে টাকা সাদা করেছেন।
কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া সব করদাতার সঙ্গে অন্যায় করার শামিল।
কালোটাকা সাদা করার সুযোগকে সমতা ও গণতন্ত্রের পরিপন্থী বলে মনে করেন দেশের বিশিষ্টজনেরা। এই টাকা মূলত আবাসন খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে, যেখানে আবার নতুন করে কালোটাকা সৃষ্টি হচ্ছে। এই টাকা আবাসনে বিনিয়োগ হওয়ায় ব্যবসায়ীরা লাভবান হচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু প্লট ও ফ্ল্যাটের দাম অযৌক্তিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। তাই এই চক্র ভেঙে দেওয়া উচিত বলে মনে করেন বক্তারা।
এসডিজি বাস্তবায়নে গঠিত নাগরিক প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন। গতকাল মঙ্গলবার সকালে অনলাইনে আয়োজিত এ সভায় সঞ্চালনা করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২০–২১ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে দেশে প্রায় ১০ হাজার ২২০ কোটি টাকা অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা হয়েছে। ৭ হাজার ৪৪৫ জন করদাতা প্রায় ৯৫০ কোটি টাকা কর দিয়ে এই অর্থ বৈধ করেছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে যা কখনো ঘটেনি। সংলাপে অংশ নেওয়া বক্তারা বলেন, কালোটাকা সাদা করার নৈতিকতা ও অর্থনীতিতে তার প্রভাব নিয়ে বিতর্ক চলে আসছে। অনেক দিন ধরে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ থাকলেও চলতি বছরে এই সুবিধা গ্রহণের ক্ষেত্রে যে উল্লম্ফন ঘটেছে, তাতে এ নিয়ে নতুন আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে।
অপ্রদর্শিত আয় বৈধ হওয়ার ফলে দেশের অর্থনীতির কোনো লাভ হচ্ছে, নাকি লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হচ্ছে, তা নিয়েও রয়েছে নানা মহলে নানা মত। এ নিয়ে আলোচনার জন্যই নাগরিক প্ল্যাটফর্ম গতকাল অনলাইনে এ সংলাপের আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে এ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ৯৬২ কোটি টাকার কর আদায় হয়েছে। এটি যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক অনেক বেশি। এত বেশি টাকা কেন সাদা হচ্ছে। ব্যাপারটা কি এই, কালোটাকার পরিমাণ আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে, নাকি প্রণোদনা বেশি কার্যকর হচ্ছে। দেবপ্রিয় প্রশ্ন তোলেন, এই টাকা কারা সাদা করছেন—ছোটরা নাকি বড়রা? কোন খাতে এই টাকা সাদা হচ্ছে। এর তাৎপর্য কী, জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে এর প্রভাব কী, তা বুঝতে হবে।
অনুষ্ঠানে ‘কালোটাকা সাদা হচ্ছে: অর্থনীতির লাভ না ক্ষতি’ শীর্ষক এক উপস্থাপনা তুলে ধরেন এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ। তিনি জানান, হংকং, ফিলিপাইন, ইরান, নিকারাগুয়া, বলিভিয়ার মতো দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে উঠেছে। প্রথম পর্বে এই সব দেশ কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছে, কিন্তু একপর্যায়ে তারা শক্ত হাতে কালোটাকার উৎস বন্ধ করেছে। ফলে সেসব দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নে চমকপ্রদ গতি এসেছে।
পাকিস্তান আমল থেকেই করছাড় দেওয়ার চল শুরু হয়েছে বলে জানান সিপিডির চেয়ারম্যান বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, একটি সময় কেবল এই সুযোগ ছিল না, সেটা হলো, বঙ্গবন্ধুর জমানায়। কালোটাকা সাদা করার সুযোগের বিশেষ ফল আসছে না। বাড়ছে না দেশের কর-জিডিপির অনুপাত। রেহমান সোবহান বলেন, কলকাতার মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা জন্মলাভের সঙ্গে কালোটাকা সাদা করার বুদ্ধিও শিখে ফেলে। মুম্বাইয়ের যে চলচ্চিত্রশিল্প, সেটাও চলে মূলত কালোটাকার শক্তিতে। এই টাকা ব্যয় হয় নির্বাচনে।
অনুষ্ঠানে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, এভাবে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া সৎ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে অন্যায়ের শামিল। তবে এই টাকাটা দেশের ভেতরেই ঘুরপাক খাচ্ছে। আবাসন খাতসহ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ হচ্ছে। শেয়ারবাজারে এখন দুই থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে। এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ আছে বলে মনে করেন তিনি। বলেন, ২০০৯ সালেও এ রকম হয়েছিল, পরে বাজার ধপাস করে পড়ে যায়।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, হুন্ডি ও বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে কালোটাকা সাদা হচ্ছে। দুদক, এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এর জন্য দায়ী। কালোটাকা প্রতিরোধের সবচেয়ে টেকসই উপায় হিসেবে তাঁরা বলেন, এনবিআরকে শক্তিশালী করতে হবে। সে জন্য দরকার বিনিয়োগ। কিন্তু কোনো সরকারই এ খাতে বিশেষ নজর দেয়নি। উন্নয়ন যা হয়েছে, তা দাতাদের জোরাজুরিতে। সরকারের তাতে বিশেষ অংশগ্রহণ নেই।
সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান রাজস্ব আদায়কারী প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করায় জোর দেন। তিনি জানান, এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, রাজস্ব আদায়কারী প্রতিষ্ঠানে এক টাকা বিনিয়োগ করা হলে ৫০ টাকা ফেরত পাওয়া যায়। অথচ বাংলাদেশের এনবিআরের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বিশেষ নজর নেই। তারা অনেক বছর লোকবল নিয়োগ করতে পারেনি। এ ছাড়া কালো টাকা বন্ধে প্রযুক্তি ব্যবহারে জোর দেন তিনি। বলেন, ভারতে যেকোনো ধরনের লেনদেনে আধার কার্ডের নম্বর ব্যবহার বাধ্যতামূলক, দেশেও তেমন ব্যবস্থা করতে হবে। প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করার বিকল্প নেই বলে তিনি মনে করেন।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন নাগরিক প্ল্যাটফর্মের ফাতেমা ইউসুফ, ব্যবসায়ী-রাজনীতিক তাবিথ আউয়াল প্রমুখ।