টিএসসির স্বপন মামা কি হেরে যাবেন করোনার কাছে

এক বছর ধরে তিনি টিকে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু প্রাক্তন শিক্ষার্থীর দেওয়া সাহায্যে। কিন্তু সেই সাহায্যও আস্তে আস্তে কমে আসছে। এদিকে ষাটোর্ধ্ব স্বপন মামার শরীরে দেখা দিয়েছে বার্ধক্যজনিত নানা অসুখ–বিসুখ। এ জন্য তাঁকে সপ্তাহে প্রায় ৫০০ টাকার ওষুধ কিনতে হয়।

মো. আবদুল জলিল মিয়া

নাম তাঁর মো. আবদুল জলিল মিয়া। পারিবারিক এই নাম তিনি ৩৭ বছর আগে রেখে এসেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়, যেখানে তাঁর জন্ম। কিন্তু ভাগ্যবিড়ম্বনায় তিন যুগ পর যখন ফিরে গেলেন শৈশব–কৈশোর–তারুণ্যের স্মৃতিময় বাড়িতে, তখন কেউ তাঁকে চেনেন না। পরিচয় দেওয়ার পর কেউ কেউ চিনলেও সহায়তার হাত বাড়াননি কিংবা তেমন সামর্থ্যও তাঁদের নেই। শূন্য হাতে ফিরে যাওয়া লোকটি স্ত্রী–সন্তান নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন।

মূলত করোনাভাইরাসই অন্য অনেকের মতো আবদুল জলিলেরও সর্বনাশ করেছে। এর আগে ঢাকায় চা–বেচা পয়সা দিয়ে ভালোই চলছিল সংসার। গত বছর করোনা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়তেই তাঁদের জীবনে চরম দুর্ভোগের শুরু হয়। কঠোর বিধিনিষেধের কারণে জীবিকা উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন চা–দোকানটি বন্ধ করে তিনি ফিরে যান পিতৃপুরুষের ভিটায়।

পাঠক, আপনারা যাঁরা সচরাচর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে (ছাত্র–শিক্ষক কেন্দ্র) গিয়েছেন, তাঁরা সবাই না হলেও অধিকাংশই এই চা–বিক্রেতাকে ভালো করেই চেনেন। বছরের পর বছর তাঁর বানানো চা খেয়েছেন। তবু টিএসসির চা–বিক্রেতা আবদুল জলিলকে চিনতে পারছেন না, এই তো? একবার ভাবুন তো, টিএসসির ‘স্বপন মামা’কে চেনেন কি না। এবার নিশ্চয়ই আপনার চোখের সামনে ভাসছে সদা হাস্যোজ্জ্বল চা–দোকানিটির চেহারা।

আবদুল জলিল ওরফে স্বপন মামা জানান, ১৯৮৪ সালে প্রথম ঢাকায় আসেন তিনি। এসেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরি করে চা বিক্রি শুরু করেন। একসময় টিএসসির পাঁচিল ঘেঁষে একটি চা–দোকান খোলেন। সেখানেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভালোবেসে তাঁর নাম দেন ‘স্বপন মামা’। এ পরিচয়েই কেটে গেল ৩৭ বছর।

চা বিক্রি করেই স্বপন মামা চার মেয়ে আর এক ছেলেকে উচ্চশিক্ষিত করার চেষ্টা করেছেন। ছেলেমেয়েরা যখন লেখাপড়ার শেষ দিকে চলে এসেছে, এমন সময় শুরু হলো করোনা। এতে সব স্বপ্ন চুরমার হয়ে যায় স্বপন মামাদের।

মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে স্বপন মামা কান্নাজড়ানো কণ্ঠে বলেন, ‘মেজ মেয়েটাকে ঈদের পরে বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। মেয়েটা থার্ড ইয়ারের পরীক্ষা দিয়েছিল, রেজাল্টও খুব ভালো। এখন জামাই যদি খরচ করে মেয়েটাকে পড়াশোনা করায়। আমার আর মেয়েটাকে পড়ানোর সাধ্য নাই।’

স্বপন মামার বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে আগেই। মেজ মেয়েটি মেধাবী, ইডেন মহিলা কলেজের ইতিহাস বিভাগে অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়েন তিনি। তৃতীয় মেয়েটি প্রতিবন্ধী, ছোট মেয়ে এ বছর এসএসসি পরীক্ষার্থী আর একমাত্র ছেলেটি শ্যামলী আইডিয়াল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী। স্বপন মামা বলেন, ‘আশা ছিল, পাস করলে ছেলেটা কাজ করবে। অনেকের সঙ্গে কথাও বলে রেখেছিলাম। আর যদি একটা বছর সময় পেতাম, মামা!’ আর বলতে পারলেন না তিনি, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন।

করোনার শুরু থেকেই বন্ধ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়। তাই বন্ধ স্বপন মামার দোকানও। গত দেড় বছরে মাত্র তিন মাস দোকান খোলা রাখতে পেরেছেন। তিনি বলেন, ‘ডিসেম্বরে যখন করোনা কিছুটা কমে আসে, ঢাকায় ফিরে গিয়েছিলাম। স্বাভাবিক সময়ের মতো না হলেও ব্যবসা হতো। এপ্রিলে আবার বিধিনিষেধ দেওয়ায় বাড়িতে ফিরে আসি। এতে অন্তত ঘরভাড়াটা বাঁচে।’

স্বপন মামা জানান, এক বছর ধরে তিনি টিকে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু প্রাক্তন শিক্ষার্থীর দেওয়া সাহায্যে। কিন্তু সেই সাহায্যও আস্তে আস্তে কমে আসছে। এদিকে ষাটোর্ধ্ব স্বপন মামার শরীরে দেখা দিয়েছে বার্ধক্যজনিত নানা অসুখ–বিসুখ। এ জন্য তাঁকে সপ্তাহে প্রায় ৫০০ টাকার ওষুধ কিনতে হয়।

স্বপন মামা বলেন, ‘করোনা আসার আগে আমি মাসে ২০–৩০ হাজার টাকা আয় করেছি। কিন্তু আমার কোনো সম্পদ নেই। কখনো জমি কিনিনি বা অন্য কোনো ব্যবসায়ও টাকা খাটাইনি। আমার সব বিনিয়োগ ছিল ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ায়। আমার ছেলেমেয়েরা দাঁড়িয়ে গেলে এই অভাব নিয়ে আমাকে ভাবতে হতো না। এখনো একটা স্কুলপড়ুয়া আর একটা প্রতিবন্ধী সন্তানের দায়িত্ব আমার ওপর। করোনা আমার সব শেষ করে দিল!’