ঢাকায় মাসে এক পরিবারের খাবার খরচ ২১,৩৫৮ টাকা

কয়েকটি নিত্যপণ্যের দাম ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। তবে তা মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে না। মূল্যস্ফীতির হিসাব নতুন করে করার বিষয়ে তাগিদ দিয়েছেন গবেষকেরা।

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবিতে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকেরা গতকাল রোববার সকালে রাজধানীর মিরপুরে সড়ক অবরোধ করেন। দুপুরের দিকে শ্রমভবনে সরকার, মালিক ও শ্রমিকদের ত্রিপক্ষীয় সভায় শ্রমিকনেতা ও সাংসদ শাজাহান খান শ্রমিকদের এই আন্দোলনকে ‘হঠকারী’ বলে উল্লেখ করেছেন।

অবশ্য বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষকেরা বলছেন, সরকারি হিসাবের চেয়েও প্রকৃত মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি। বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী ঢাকার কেন্দ্রস্থলে বসবাসরত একজন ব্যক্তির মাসিক খাবার খরচ ৫ হাজার ৩৩৯ টাকা। চারজনের একটি পরিবারের ক্ষেত্রে এই খরচ হচ্ছে ২১ হাজার ৩৫৮ টাকা। যদি কোনো পরিবার পুরো মাসে একবারও মাছ, গরুর মাংস, খাসির মাংস ও মুরগি না খায়, তাহলেও খরচ ৮ হাজার ১০৬ টাকা। ব্যক্তি বা পরিবারের মাসিক এই খাবার খরচ গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১১ শতাংশ বেশি।

খাবারের সঙ্গে এক কক্ষের ঘরভাড়া, গ্যাস-বিদ্যুতের বিল, চিকিৎসা ব্যয়, স্বাস্থ্য সুরক্ষার পণ্য ক্রয়, সন্তানের পড়ালেখার খরচ, যাতায়াত, মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের বিল হিসাব করলে ঢাকার আশপাশের এলাকায় চার সদস্যের এক পরিবারের মাসিক খরচ গিয়ে দাঁড়ায় ৪২ হাজার ৫৪৮ টাকা। তবে ঢাকার কেন্দ্রস্থলে বাড়িভাড়া বেশি। সে ক্ষেত্রে মাসিক খরচ হবে ৪৭ হাজার ১৮২ টাকা। খাবারের তালিকা থেকে মাছ, গরুর মাংস, খাসির মাংস ও মুরগি বাদ দিলেও তা ৩৩ হাজার ৮৪১ টাকায় দাঁড়ায়।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে মানুষকে কিছুটা সুবিধা দিতে জ্বালানি ও কৃষিতে ভর্তুকি রাখতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর শুল্ক ও কর সাময়িক সময়ের জন্য তুলে দেওয়া প্রয়োজন। যারা বাজার নিয়ন্ত্রণ ও সিন্ডিকেট করার চেষ্টা করবে, তাদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।
ফাহমিদা খাতুন, নির্বাহী পরিচালক, সিপিডি

চলতি অর্থবছরের সার্বিক অর্থনীতি পর্যালোচনায় নিয়ে মিডিয়া ব্রিফিংয়ে সিপিডির গবেষকেরা এই তথ্য জানান। রাজধানীর ধানমন্ডিতে সিপিডি কার্যালয়ে গতকাল রোববার এই অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্য পাঠ করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, জ্যেষ্ঠ গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান, গবেষক সৈয়দ ইউসুফ সাদাত প্রমুখ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৯ সালের নগর আর্থসামাজিক অবস্থা নিরূপণ জরিপে একজন মানুষের গড় খাবার ব্যয়ের তথ্য প্রকাশ করা হয়। সেই খাদ্যতালিকার মধ্য থেকে সাধারণ ২০টি খাবারের দাম বর্তমান বাজারদরের সঙ্গে হিসাব করে সিপিডি চার পরিবারের মাসিক খরচের হিসাবটি দাঁড় করিয়েছে। এ ক্ষেত্রে গত ৩০ মে বাংলাদেশ ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবির) পণ্যমূল্য বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর পণ্যের দাম বাড়ার বড় কারণ ছিল বিশ্ববাজার। সেই সঙ্গে যুক্ত হয় জাহাজভাড়া বেড়ে যাওয়া। এরপর নিজেদের খাদ্যপণ্য সুরক্ষায় বিভিন্ন দেশ রপ্তানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করায় পণ্যের দামে দফায় দফায় উত্থান হয়। ঈদের পর ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়ে পণ্য আমদানিতে আরেক দফা খরচ বেড়েছে।

ফাহমিদা খাতুন বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে মানুষকে কিছুটা সুবিধা দিতে জ্বালানি ও কৃষিতে ভর্তুকি রাখতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর শুল্ক ও কর সাময়িক সময়ের জন্য তুলে দেওয়া প্রয়োজন। তা ছাড়া বাজারকে প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি বাজারকে বাজারের মতো চলতে দেওয়া উচিত। যারা বাজার নিয়ন্ত্রণ ও সিন্ডিকেট করার চেষ্টা করবে, তাদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।

শ্রমিকের মজুরিতে মিটছে না ব্যয়

দেশের কোনো শিল্প খাতের শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরিই চার সদস্যের পরিবারের এক মাসের খাবার খরচ অর্থাৎ ২১ হাজার ৩৫৮ টাকার কাছাকাছি নয়। এমনকি মাছ, গরুর মাংস, খাসির মাংস ও মুরগি বাদ দিয়েও মাসিক ৮ হাজার ১৬ টাকা খাবার খরচও কোনো কোনো খাতের শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি দিয়ে মেটানো সম্ভব হচ্ছে না।

২১ খাতের শ্রমিক-কর্মচারীদের ন্যূনতম মজুরি হিসাব করে বিষয়টি দেখিয়েছে সিপিডি। যেমন প্রতিবছর ৫ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধি বিবেচনায় নিলে চামড়া ও জুতা কারখানার শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বর্তমানে ৭ হাজার ৪৫৯ টাকা। এই খাতের কর্মচারীদের ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার ৯৮১ টাকা।

এখনো ২৯টি নিত্যপণ্য আমদানিতে শুল্ক আরোপ রয়ে গেছে। আমদানি ও উৎপাদক পর্যায় থেকে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছানোর ব্যবস্থাপনায় আমাদের দুর্বলতা আছে। সেখানে নজরদারি ও খবরদারি করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেও পণ্যের দাম কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।
মোস্তাফিজুর রহমান, বিশেষ ফেলো, সিপিডি

একইভাবে তৈরি পোশাক খাতের ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার ৮৮৪ টাকা। সর্বোচ্চ রপ্তানি আয়ের এ খাতের কর্মচারীদের ন্যূনতম মজুরি ৯ হাজার ৩১২ টাকা। তার মানে চামড়া ও জুতা কারখানা কিংবা তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকের ন্যূনতম যে মজুরি, তা দিয়ে চারজনের একটি পরিবারের মাসিক খাবার খরচ মেটানো সম্ভব হচ্ছে না।

বর্তমানে শিল্প খাতের মধ্যে জাহাজভাঙায় ন্যূনতম মজুরি সবচেয়ে বেশি। প্রতিবছর ৫ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধি ধরলে এ খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১৭ হাজার ৭২৪ টাকা। আর কর্মচারীদের মজুরি ১৬ হাজার ৬৯৫ টাকা। এই খাতের শ্রমিকেরা যে মজুরি পান, তা দিয়ে চারজনের একটি পরিবারের মাসিক খাবার খরচ মিটছে না।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সব খাতের শ্রমিকের মজুরি সমন্বয়ের উদ্যোগ নেওয়া দরকার। তৈরি পোশাকসহ বেশির ভাগ খাতের রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে খুব বেশি সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কোন পথে

তিন মাস ধরে মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশের বেশি। কয়েক মাসের ব্যবধানে সয়াবিন তেল, আটা, চাল, ডালসহ বিভিন্ন ধরনের নিত্যপণ্যের দাম ব্যাপক হারে বাড়লেও বিবিএসের মূল্যস্ফীতির হিসাবে তা ঠিকঠাকভাবে আসছে না বলে অভিযোগ করছেন অর্থনীতিবিদেরা। সিপিডির গবেষকেরাও সেই কথা আবারও বললেন। তাঁদের বক্তব্য, কয়েকটি নিত্যপণ্যের দাম ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। তবে তা মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে না। আবার ২০০৫-০৬ সালকে ভিত্তিবছর ধরে মূল্যস্ফীতি হিসাব করা হচ্ছে। অথচ এত দিনে মানুষের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এসেছে। তাই মূল্যস্ফীতির হিসাব নতুন করে করার বিষয়ে তাগিদ দেন তাঁরা।

তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, যাঁরা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আছেন, তাঁরা যদি প্রতিদিন বাজার করতেন, তাহলে বুঝতে পারতেন মূল্যস্ফীতি ৫ বা ৬ শতাংশের ঘরে নেই। এটি আরও অনেক বেশি। যেকোনো ধরনের নীতিনির্ধারণের জন্য বস্তুনিষ্ঠ তথ্য দরকার বলে মন্তব্য করেন সিপিডির এই জ্যেষ্ঠ গবেষক।

মূল্যস্ফীতি বাড়লেও মজুরি যদি কিছুটা বাড়ানো যায়, তাহলেও স্বস্তি পাবেন শ্রমিকেরা—এমনটাই মন্তব্য করেন মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারের সম্পর্ক আছে। তবে শুধু আন্তর্জাতিক কারণে পণ্যের মূল্য বাড়ছে বললে কিন্তু ভুল হবে। দেশের অভ্যন্তরে শুল্ক কীভাবে নির্ধারিত হচ্ছে? সয়াবিন তেলের ক্ষেত্রে শুল্ক কমানোর পর কিছুটা সুফল মিলেছে।

এখনো ২৯টি নিত্যপণ্য আমদানিতে শুল্ক আরোপ রয়ে গেছে। আমদানি ও উৎপাদক পর্যায় থেকে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছানোর ব্যবস্থাপনায় আমাদের দুর্বলতা আছে। সেখানে নজরদারি ও খবরদারি করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেও পণ্যের দাম কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।’

চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি অর্থনীতি

ব্রিফিংয়ের শুরুতেই বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করেন ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, এর মধ্যে রয়েছে মূল্যস্ফীতির চাপ, বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি, চলতি হিসাবে ঘাটতি, বিনিময় হারে অস্থিতিশীলতা এবং বৈদেশিক রিজার্ভের ওপর চাপ। সে কারণে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা একধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রশ্নে তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজস্ব ও মুদ্রানীতির মধ্যে সমন্বয় করতে হবে।

বাস্তবসম্মত একটি মুদ্রানীতি দরকার। যেসব খাতে ভর্তুকি দরকার, সেসব খাতে ভর্তুকি দিতে হবে। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বন্ধ করা উচিত। তবে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বজায় রাখার পাশাপাশি বাজারে পণ্য সরবরাহ ঠিক রাখতে হবে, যাতে বিনিয়োগ হয়, সেই সঙ্গে কর্মসংস্থানও বাড়ে।

জিডিপির হিসাব নিয়ে প্রশ্ন তুলে ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘প্রবৃদ্ধি যেটা হচ্ছে সেটা কোথা থেকে হচ্ছে। এটা বিশ্বাসযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। জিডিপির হিসাব বাস্তবসম্মত করা দরকার। কারণ, নীতিমালা যেগুলো নেওয়া হয়, সেগুলো জিডিপির বিভিন্ন সহগের ওপর নির্ভরশীল। জিডিপির হিসাব সঠিক না হলে নীতিমালা কার্যকর হয় না। জিডিপি নিয়ে আমাদের দুর্বলতা রয়েছে। তবে জিডিপির বণ্টন কতটা হচ্ছে, সেটি গুরুত্বপূর্ণ। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে।’

ডলার-সংকট কাটাতে মুদ্রাটির বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক হিসেবে মন্তব্য করেন মোস্তাফিজুর রহমান। তবে তিনি বলেন, ‘প্রবাসী আয়ে প্রণোদনা দেওয়া যুক্তিহীন। প্রবাসী আয়ে প্রণোদনা কমানোর সময় এসেছে। গত মাসে খোলাবাজার ও ব্যাংক মাধ্যমে ডলারের দামের পার্থক্য ১০-১২ টাকা ছিল।

এখন পার্থক্য কমে এসেছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠালে যে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া হয়, তার কোনো প্রয়োজন দেখছি না। অন্যদিকে শ্রমিকেরা যে হারে প্রবাসে যাচ্ছেন, সেই হারে ব্যাংকিং চ্যানেলে বৈদেশিক মুদ্রা আসছে না।’ এ বিষয়ে শ্রমিকদের সচেতন করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে পরামর্শ দেন তিনি।