ত্রাণ গুদাম নির্মাণে প্রকল্প–বিলাস

  • প্রস্তাবিত ২৪৫টি কেন্দ্রের মধ্যে ৪২টিই কোথায় হবে জানে না কেউ।

  • যখন সরকারের রাজস্ব কমছে, তখন ৯০৯ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব।

ভৌগোলিকভাবে দিনাজপুর জেলা বেশ উঁচু হওয়ায় সেখানে সচরাচর বন্যা দেখা যায় না। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগেও দিনাজপুর ঝুঁকিমুক্ত। অথচ এই জেলার ১৩টি উপজেলার মধ্যে ১০টিতেই কিনা দুর্যোগ তথ্যকেন্দ্র ও ত্রাণ গুদাম করতে চায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর।

এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হিসেবে দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে ক্ষতিগ্রস্তদের সহজে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করার কথা বলা হয়েছে। তাহলে প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগেই ঝুঁকিতে পড়ে, এমন উপজেলাগুলো বাদ পড়ল কেন? আর যেখানে দুর্যোগই হয় না, সেখানে কোটি কোটি টাকা খরচ করে দুর্যোগ তথ্যকেন্দ্র ও ত্রাণ গুদাম নির্মাণের যৌক্তিকতাই-বা কী?

ঝুঁকিমুক্ত অনেক উপজেলায় দুর্যোগ তথ্যকেন্দ্র ও ত্রাণ গুদাম নির্মাণের প্রস্তাব। অথচ প্রবল ঝুঁকিতে থাকা অনেক উপজেলাকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, দিনাজপুর জেলাটি বেশ উঁচু এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় সেখানে খুব একটা বন্যা দেখা যায় না। দেখা গেলেও তা কালেভদ্রে। যেমন ২০১৭ সালের বন্যায় শুধু জেলা সদর আক্রান্ত হয়েছিল। বাকি উপজেলাগুলোয় পানি ওঠেনি। দিনাজপুরে বন্যা সৃষ্টিকারী বড় কোনো নদীও নেই। তা ছাড়া জেলাটি দুর্যোগমুক্ত।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী দেশের প্রতিটি জেলা শহরে সরকারি জমিতে বর্তমানে একটি করে দুর্যোগ তথ্যকেন্দ্র ও ত্রাণ গুদাম নির্মাণের কাজ চলছে। করোনার মধ্যে নতুন করে ২৪৫টি উপজেলায় নতুন কেন্দ্র করতে চায় এই অধিদপ্তর। এর মধ্যে ঝুঁকিমুক্ত জেলা দিনাজপুরেই সর্বোচ্চ নয়টি কেন্দ্র বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। যেসব উপজেলার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে, সেগুলো হলো চিরিরবন্দর, নবাবগঞ্জ, পার্বতীপুর, ঘোড়াঘাট, বিরামপুর, ফুলবাড়ী, কাহারোল, বিরল ও বোচাগঞ্জ। জেলা সদরে একটি ত্রাণ গুদামের নির্মাণকাজ এখন চলছে। সব মিলিয়ে ১০টি।

প্রতিটি জেলায় একটি করে ত্রাণ গুদাম নির্মাণের পর নতুন করে আরও ত্রাণ গুদাম নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা আছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আমরা আপাতত কোভিডের কারণে প্রকল্পটি ফেরত পাঠিয়েছি।
মতিউর রহমান, অতিরিক্ত সচিব, পরিকল্পনা কমিশন

এদিকে যে ২৪৫টি উপজেলায় দুর্যোগ তথ্যকেন্দ্র ও ত্রাণ গুদাম নির্মাণের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে ৪২টিরই কোনো নাম-ঠিকানাই নেই। অর্থাৎ এগুলো কোথায় হবে, আর হলেও সেই এলাকা আদৌ দুর্যোগপ্রবণ কি না, এমন তথ্যও নেই। অথচ এসব কেন্দ্রের জন্য মোট ১১৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। প্রতিটির জন্য ২ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। আর সব মিলিয়ে ‘উপজেলা দুর্যোগ তথ্যকেন্দ্র ও ত্রাণ গুদাম নির্মাণ’ শীর্ষক এই প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৯০৯ কোটি টাকা।

নাম-ঠিকানাবিহীন ৪২টি কেন্দ্র সম্পর্কে জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) আতিকুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ভবিষ্যতে যদি প্রয়োজন হয়, সে জন্য বাড়তি কিছু দুর্যোগ তথ্যকেন্দ্র ও ত্রাণ গুদাম নির্মাণের জন্য টাকা চাওয়া হয়েছে। তবে কোথায় এসব কেন্দ্র নির্মিত হবে, সেই সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। তিনি বলেন, সরকার যদি মনে করে কোনো উপজেলা বাদ দেওয়া দরকার, তাহলে সেটাই করা হবে।

বাকি ২০৩টি দুর্যোগ তথ্যকেন্দ্র ও ত্রাণ গুদামের তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সত্যিকার অর্থেই ঘূর্ণিঝড়, বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিস্থিতিতে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত, এমন অনেক উপজেলার নাম নেই। তেমনই একটি হলো বরগুনার তালতলী উপজেলা, যেটি ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলায় বিধ্বস্ত হয়েছিল। দক্ষিণের এই উপজেলা যেকোনো দুর্যোগেই ঝুঁকিপূর্ণ। অথচ এটিই কিনা তালিকায় নেই। অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ অবস্থানে থাকা একই জেলার আরেক উপজেলা আমতলীকে তালিকায় রাখা হয়েছে। একইভাবে ঢাকার পার্শ্ববর্তী গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলাও বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়মুক্ত বলে বিবেচিত হলেও তালিকায় রাখা হয়েছে।

মূলত রাজনৈতিক বিবেচনা ও প্রভাবশালীদের প্রভাবেই ঝুঁকিমুক্ত বহু উপজেলার নাম তালিকায় ঢোকানো হয়েছে, তা নিঃসন্দেহ। তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের দাবি, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়েই তালিকাটি করা হয়েছে। তালিকা করতে কোনো ধরনের চাপ ছিল না।

প্রকল্প প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, প্রতিটি দুর্যোগ তথ্যকেন্দ্র ও ত্রাণ গুদাম হবে তিন তলাবিশিষ্ট। নিচতলা হবে গুদামঘর, যেখানে টিন, শুকনা খাবারসহ অন্যান্য ত্রাণসামগ্রী রাখা হবে। আর ওপরের দুই তলা হবে দুর্যোগ তথ্যকেন্দ্র, যেখান থেকে মানুষকে আগাম সতর্কসংকেত দেওয়া হবে।

নতুন প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। সেটি যাচাই-বাছাই করে কমিশন বলেছে, দেশের প্রতিটি জেলা শহরে একটি করে এখন দুর্যোগ তথ্যকেন্দ্র ও ত্রাণ গুদাম নির্মাণের চলমান কাজ শেষ না করে সমজাতীয় আরেকটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া যায় না।

পরিকল্পনা কমিশন বলছে, ২৪৫টি উপজেলার মধ্যে এমন অনেক উপজেলা আছে, যেখানে দুর্যোগ তথ্যকেন্দ্র নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা নেই। আবার যেসব উপজেলায় দরকার, সেগুলোর নাম নেই তালিকায়। এর ওপর চলছে করোনা মহামারি। জমি পাওয়া নিয়েও আছে অনিশ্চয়তা। এ ছাড়া সরকারের রাজস্ব আদায় কমে যাওয়ায় নির্মাণসংক্রান্ত প্রকল্প অনুমোদন বন্ধ রয়েছে। নাম-ঠিকানাহীন ৪২টি দুর্যোগ কেন্দ্রের প্রস্তাব দেখেও বিস্মিত কমিশন। এসব দিক বিবেচনা করে প্রকল্পটি অনুমোদনের বদলে ফেরত পাঠানো হয়েছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের পরিচালক (উন্নয়ন) এ টি এম কামরুল ইসলাম পরিকল্পনা কমিশন থেকে প্রকল্পটি ফেরত পাঠানোর কথা স্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, তারা জানিয়েছে যে করোনা মহামারির সময়ে সরকারের আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় এখন প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া যাবে না।

তবে পরিকল্পনা কমিশনের অতিরিক্ত সচিব মতিউর রহমান বলেন, ‘প্রথম দফায় প্রতিটি জেলায় একটি করে ত্রাণ গুদাম নির্মাণের পর নতুন করে আরও ত্রাণ গুদাম নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা আছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আমরা আপাতত কোভিডের কারণে প্রকল্পটি ফেরত পাঠিয়েছি। পরে যদি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়, তখন আমরা এসব বিষয় জানতে চাইব।’

আরও কিছু উদাহরণ

তথ্য বলছে, চাঁদপুর সদর উপজেলা দুর্যোগের সময়ে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ থাকে। সেখানে অন্তত ১০টি চর আছে, যেখানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ৬০ হাজার মানুষ বসবাস করে। কিন্তু দুর্যোগের তালিকায় এই উপজেলাকে রাখা হয়নি। অন্যদিকে চাঁদপুরের মতলব উত্তর ও দক্ষিণ উপজেলা দুটি মোটামুটি ঝুঁকিমুক্ত হলেও প্রকল্পে ঢোকানো হয়েছে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী মৌলভীবাজারের পাহাড়ি বনাঞ্চলে গঠিত উপজেলা কমলগঞ্জে শেষবার বন্যা হয়েছিল ১৯৯১ সালে, যা স্থায়ী ছিল মাত্র এক দিন। অথচ সেখানেও দুর্যোগ তথ্যকেন্দ্র ও ত্রাণ গুদাম নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। একইভাবে রংপুরের তারাগঞ্জ, মিঠাপুকুর ও পীরগঞ্জ উপজেলাকেও এই প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।