দেশেই ৭০ শতাংশ পণ্য উৎপাদন করবে সিঙ্গার বাংলাদেশ

১১৭ বছর ধরে বাংলাদেশে ব্যবসা করছে সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেড। সেলাই মেশিন দিয়ে শুরু করে তারা এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন ইলেকট্রনিক সামগ্রী বিক্রি ও উৎপাদন করছে। কোম্পানির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এম এইচ এম ফাইরোজ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রতীক বর্ধন

এম এইচ এম ফাইরোজ

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: ১১৭ বছর ধরে সিঙ্গার বাংলাদেশ ব্যবসা করছে। এই সফলতার পেছনে কোন কোন বিষয় কাজ করেছে?

এম এইচ এম ফাইরোজ: দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবসা করতে গ্রাহকের আস্থা অর্জন করতে হয়। সিঙ্গারের এই দীর্ঘ যাত্রা শুরু হয়েছে সেলাই মেশিনের ব্যবসা দিয়ে। মূলত এটাই আমাদের আজ এই জায়গায় আসতে সহায়তা করেছে।

মানসম্মত পণ্য ও সেবা দেওয়ার পাশাপাশি আমরা গ্রাহকদের পরিবর্তনশীল চাহিদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে ব্যবসায়িক মডেল পরিবর্তন করেছি। যেমন এত দিন আমরা বিক্রয়কেন্দ্রে পণ্য বিক্রি করেছি, এখন ই-কমার্স সাইটের মাধ্যমে ব্যবসা করছি। বাংলাদেশে ই-কমার্স এখনো উন্নত দেশগুলোর মতো জনপ্রিয় না হলেও তার গুরুত্ব দিনকে দিন বাড়ছে। তবে এই ধরনের প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা গ্রাহকের জীবনে প্রাসঙ্গিক থাকার চেষ্টা করছি।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আগামী পাঁচ বছরে সিঙ্গার কোথায় যাবে বলে মনে করছেন?

ফাইরোজ: ব্র্যান্ডের পরিচিত বাড়ানো এবং নিজেদের সক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করা—এটাই আমাদের মূল লক্ষ্য। আমাদের সফলতা আছে, এখন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা মাথায় রেখে কাজ করছি। এ ক্ষেত্রে আমরা বৈশ্বিক শীর্ষ কোম্পানিগুলোর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে চাই। সিঙ্গার বাংলাদেশের অংশীদার আর্চেলিক দীর্ঘস্থায়ী গৃহস্থালি পণ্য উৎপাদন করে, ফলে তাদের কাছ থেকে আমরা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানতে পারছি।

আর বাংলাদেশে কী হচ্ছে, মানুষ কী চাচ্ছে, তা-ও আমরা বোঝার চেষ্টা করছি। একটি বিষয় পরিষ্কার, মানুষের চাহিদা ও কেনার অভ্যাস বদলে যাচ্ছে। মানুষ নির্ঝঞ্ঝাট জীবন চায়, সে জন্য সেবার ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে তারা।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: মহামারির মধ্যে সারা বিশ্বের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আপনাদের অভিজ্ঞতা জানতে চাই।

ফাইরোজ: হ্যাঁ, শুধু সিঙ্গার নয়, ২০২০ সালে সবার ব্যবসাই খারাপ গেছে। মহামারির কারণে আমরা স্বাভাবিক ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালাতে পারিনি। আবার ২০২১ সালে ঈদুল আজহার আগে বিধিনিষেধ ছিল, আমরা বিক্রয়কেন্দ্র খুলতেই পারিনি। বলা দরকার, আমাদের ৮০ শতাংশ রাজস্ব আসে খুচরা বিক্রয়কেন্দ্র থেকে। সে কারণে ২০২১ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে আমরা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ি।

তবে সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে সিঙ্গার ও আর্চেলিক ওই সময় মুনাফা করতে না পারলেও কর্মীদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে তৎপর থেকেছে। মহামারির কারণে সিঙ্গার বাংলাদেশের একজন কর্মীরও চাকরি যায়নি। অথচ শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের অনেক কোম্পানিতেই ছাঁটাই হয়েছে, বেতন কমানো হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, কর্মীরাই কোম্পানির সবচেয়ে বড় সম্পদ, পরিস্থিতির উন্নতি হলে তাঁরাই কোম্পানিকে দাঁড় করাবেন।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আর্চেলিক সিঙ্গার বাংলাদেশের অংশীদার হওয়ার পর কী পরিবর্তন এল?

ফাইরোজ: আমি মনে করি, সিঙ্গার ও আর্চেলিক আদর্শ জুটি হয়ে উঠেছে। আর্চেলিক আসার আগের সময়ে যান, তখন সিঙ্গার ছিল মূলত বিক্রয়কারী কোম্পানি। তখন আমরা বিভিন্ন সরবরাহকারীর কাছ থেকে পণ্য এনে বিক্রি করতাম। আমাদের তখন সেলাই মেশিনের কারখানা ছিল। এ ছাড়া সিঙ্গারের বৈশ্বিক কারখানা থেকে ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, টেলিভিশন কিনে আনতাম আমরা। সময়ের পরিক্রমায় আমরা বাংলাদেশেও টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটর, ওয়াশিং মেশিন ও শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র উৎপাদন শুরু করি।

কিন্তু একটি বিষয়, এসব কারখানার জন্য আমাদের গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগ ছিল না। দেশে উৎপাদন করলে শুল্ক ছাড় আছে, সে জন্য সরবরাহকারীদের ডেকে এখানে কারখানা খোলা হয়, আমরা জমি দিয়েছি, তারা সবকিছু করে দিয়েছে, এরপর আমরা কেবল টাকা দিয়েছি।

আর্চেলিক এখানেই উন্নতি ঘটিয়েছে। বিশ্বের ৯টি দেশে তাদের ২৮টি কারখানা আছে—কর্মী আছে ৪০ হাজার। তাদের গবেষণা-উন্নয়ন ও ডিজাইন কেন্দ্র আছে ৩০টি। তাদের গবেষক আছে ১৭ হাজার এবং আন্তর্জাতিক পেটেন্ট আছে ৩ হাজার। তারা আসার পর আমরা এখন গবেষকদের গবেষণালব্ধ জ্ঞান লাভ করছি।

দেশে দীর্ঘস্থায়ী ভোক্তা পণ্যের চাহিদা বাড়বে। সে জন্য আর্চেলিক এখানে আরও বিনিয়োগ করতে চায়। আর সরকারও দেশে উৎপাদনে উৎসাহ দিচ্ছে। এখন আমাদের বিক্রীত পণ্যের প্রায় ৫২ ভাগ দেশেই উৎপাদিত হয়। আমাদের পরিকল্পনা হলো, এই পরিসংখ্যান ৬০ থেকে ৭০ শতাংশে নিয়ে যাওয়া। ইতিমধ্যে আমরা স্থানীয় উৎস থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ শুরু করেছি।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: দেশে বড় একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণি আছে। নতুন মধ্যবিত্তের বিকাশও হচ্ছে দ্রুতগতিতে। গবেষকেরা বলেন, এই নতুন মধ্যবিত্ত ভবিষ্যতে মানসম্মত পণ্য খুঁজবে। সেই চাহিদা মেটানোর প্রস্তুতি আপনাদের কেমন?

ফাইরোজ: অর্থনীতির বিকাশ হলে মানুষের হাতে ব্যয় করার মতো টাকার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। তখন মানুষ জীবনমানের উন্নতি ঘটাতে চায়—এটাই স্বাভাবিক। এখন ব্র্যান্ড হিসেবে মধ্যম সারিতে আমাদের অবস্থান। আরেকটু উন্নত মানের পণ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে আর্চেলিকের বড় ভূমিকা থাকবে। তাদের একটি ব্র্যান্ড হচ্ছে বেকো—যুক্তরাজ্যের অন্যতম শীর্ষ ব্র্যান্ড এটি। এ ছাড়া আর্চেলিকের ১২টি ব্র্যান্ড আছে। গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী সেসব পণ্য বাজারজাত করা হবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনি বাংলাদেশে আছেন সাত বছর হলো। দেশের ব্যবসায়িক পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার সম্যক ধারণা আছে। আরও বেশি হারে এফডিআই বা প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে বাংলাদেশ কী করতে পারে বলে মনে করেন?

ফাইরোজ: বিনিয়োগকারীরা দেখতে চায় সরকার কী ধরনের সহায়তা দিচ্ছে এবং বিনিয়োগ প্রক্রিয়া কতটা সহজ। এরপর তারা দেখতে চায় ব্যবসা করার পরিবেশ কেমন। ফলে সরকারকে এই দুই খাতে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।

কথা হচ্ছে, ভিয়েতনাম বাংলাদেশের চেয়ে এত বেশি বিনিয়োগ পাচ্ছে কেন। অন্যান্য উদীয়মান দেশ কীভাবে এফডিআই আকর্ষণ করছে, সেটাও দেখতে হবে। এখন তৈরি পোশাক খাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কেন আসছে, তারা নিশ্চয়ই বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসা থেকে আসছে না, ব্যবসার সম্ভাবনা দেখেই আসছে। এই সফলতা অন্যান্য খাতেও লাভ করা সম্ভব।