দেশ ধনী হচ্ছে, প্রশ্ন বৈষম্য নিয়ে

গ্লোবাল ফাইন্যান্স ম্যাগাজিন বলছে, বাংলাদেশ চলতি ২০২১ সালে তিন ধাপ এগিয়ে বিশ্বের ১৪০তম ধনী দেশ হয়েছে।

একসময় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) তৈরি ‘দুর্নীতি ধারণা সূচকে’ প্রথম স্থানে ছিল বাংলাদেশ। এ নিয়ে দেশ-বিদেশে বেশ হইচই পড়ে যেত, তুমুল সমালোচনা হতো। পরবর্তীকালে ওই সূচকে বাংলাদেশের নাম পেছনের দিকে গেলেও আলোচনা-সমালোচনা কমেনি। তবে এটাই কেবল বাংলাদেশের প্রকৃত চিত্র নয়। এর বাইরে আছে অন্য এক বাংলাদেশ। সেটি অবশ্য সমালোচিত হওয়ার নয়, বরং প্রচুর সম্ভাবনার বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের নতুন সম্ভাবনার খবরটি দিয়েছে গ্লোবাল ফাইন্যান্স ম্যাগাজিন। তাদের এ বছরের জরিপে বিশ্বের শীর্ষ ধনী দেশের তালিকায় বাংলাদেশ তিন ধাপ এগিয়েছে। গ্লোবাল ফাইন্যান্স-এর চলতি ২০২১ সালের তালিকায় বাংলাদেশ ১৪০তম ধনী দেশ। গত বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪৩। ম্যাগাজিনটি বলছে, ক্রয়ক্ষমতার সমতার ভিত্তিতে (পিপিপি) বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) এখন ৫ হাজার ৩০৭ ডলার, যা গত বছর ছিল ৫ হাজার ২৮ ডলার।

গ্লোবাল ফাইন্যান্স-এর এবারের তালিকায় মোট ১৯৪টি দেশের নাম রয়েছে। এতে বাংলাদেশের প্রতিবেশদের মধ্যে ভারত ১২৪তম অবস্থান থেকে চার ধাপ পিছিয়ে ১২৮তম হয়েছে। পাকিস্তানের অবস্থা আরও খারাপ। তারা গত বছরের ১৩৮তম অবস্থান থেকে ছয় ধাপ পিছিয়ে ১৪৪তম স্থানে নেমে গেছে। বদৌলতে বিশ্বে ধনী রাষ্ট্র সূচকে পাকিস্তান এবার বাংলাদেশের চার ধাপ পেছনে অবস্থান করছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকের তথ্যের ভিত্তিতে এই তালিকা প্রকাশ করেছে গ্লোবাল ফাইন্যান্স ম্যাগাজিন। তালিকায় চলতি ২০২১ সালে বিশ্বের ধনী দেশগুলোর তালিকায় শীর্ষস্থান পেয়েছে লুক্সেমবার্গ।

■ তালিকায় ১৯৪টি দেশের মধ্যে শীর্ষস্থান পেয়েছে লুক্সেমবার্গ। ■ ভারত ১২৪তম স্থান থেকে চার ধাপ পিছিয়ে ১২৮তম হয়েছে।

এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, দেশে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় বেড়ে ২ হাজার ২২৭ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ লাখ ৮৮ হাজার ৮৭৩ টাকা। করোনার এ সময়ে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, ধনী দেশের তালিকায় এগিয়ে যাওয়া একটি ভালো খবর বটে। তবে তা দিয়ে সার্বিক চিত্র বোঝা যায় না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদেরা। তাঁরা মনে করেন, করোনাকালে কিছু মানুষ অতিধনী হয়েছে। আবার করোনায় অর্থনীতিতে যে অভিঘাত পড়েছে, তা ধনীর অবস্থার তেমন পরিবর্তন করেনি, কিন্তু তা দরিদ্রকে অতিদরিদ্র অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে। আবার নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন অনেকে। ফলে এ সময় এ ধরনের চিত্র বৈষম্য বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়।

করোনা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, মাথাপিছু আয় বাড়ে তখনই যখন জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি হয়। সেই হিসাবে মাথাপিছু আয় বেড়েছে। তবে এসব তথ্য–উপাত্ত সরকারিভাবে আসে। যাচাই-বাছাইয়ের তেমন সুযোগ নেই। এ ছাড়া বিবিএসের পক্ষে যেভাবে সংগ্রহ করা সম্ভব সেভাবে অন্য সংস্থার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই বলা যায়, জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে সরকারি নীতিনির্ধারকেরা যা তথ্য দেন তার ভালো ব্যাখ্যা তাঁরাই দিতে পারবেন।

সেলিম রায়হান আরও বলেন, ‘সরকারি তথ্য অনুযায়ী দেশে গত বছর ৫ শতাংশের কাছাকাছি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অথচ আইএমএফ বিশ্বব্যাংকের হিসাবে তা ১ থেকে দেড় শতাংশের বেশি নয়। এ ছাড়া আমরা দেখতে পাচ্ছি করোনা মহামারির এ সময়ে আমাদের রপ্তানিসহ বড় শিল্প খাতগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি ভালো। সামগ্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অর্থনীতি। অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। সে জন্য বলা যেতে পারে, সরকারি তথ্য–উপাত্ত কতটা বিশ্বাসযোগ্য ও ব্যাপক সংযোগের মাধ্যমে সংগ্রহ হয়েছে, তা দেখা দরকার। এখানে সরকারি সংস্থাগুলো কতটা দক্ষতা, যোগ্যতা ও সামর্থ্য নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছে, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের আরেক অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা বলেন, ‘করোনার এই সময়ে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিতে বড় ধরনের বৈষম্য আছে এমনটাই ইঙ্গিত করে। জিডিপিতে প্রবৃদ্ধি হলে মাথাপিছু আয় বাড়তে পারে। তবে করোনাকালে সার্বিক অর্থনীতিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নানা জরিপে দেখা গেছে, বহু লোক কাজ হারিয়েছে বা মানুষের আয় কমেছে। কিছু কিছু খাতে অর্থনীতি ভালো করেছে। তবে সার্বিকভাবে সেই প্রতিফলন দেখি না।’

সায়মা হক বিদিশা বলেন, ‘আসলে করোনার আগেও আমরা দেখেছি বৈষম্য বাড়ছে। করোনার মধ্যে তা আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাই বেশি। অর্থাৎ ধনীর সঙ্গে গরিবের পার্থক্য আরও বেড়েছে। তাই হয়তো মাথাপিছু আয় বেড়েছে। তবে আমাদের দেখার বিষয় হলো, মানুষ কী অবস্থায় আছে। দারিদ্র্যের হার কেমন, কর্মসংস্থানের হার কেমন ও বৈষম্যের হার কেমন। আমাদের আসলে প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক উন্নয়নের দর্শন থেকে সরে আসতে হবে। মাথাপিছু আয় দিয়ে সব বিচার করলে পুরো চিত্রটা উঠে আসবে না।’

শুরুর দিকে বাংলাদেশের সম্ভাবনা কথা বলা হয়েছে। সে রকম সম্ভাবনাগুলোর একটি শুনিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান অ্যান্ড স্যাকস। ব্যাংকটি বিনিয়োগ সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বিবেচনায় ২০০৫ সালে ১১টি দেশের একটি তালিকা প্রকাশ করে। ‘নেক্সট ইলেভেন’ বা ‘পরবর্তী একাদশ’ নামের ওই তালিকায় বাংলাদেশও ঠাঁই পেয়েছিল। বাকি দশ দেশ হলো ইন্দোনেশিয়া, ইরান, তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, মিসর ও মেক্সিকো।