সাক্ষাৎকার
ধান-চালের ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছে বড় করপোরেটরা
ধান-চালের জন্য বিখ্যাত জেলা দিনাজপুর। এ জেলায় চালকলের পাশাপাশি নতুন করে নানা ধরনের শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে। নতুন নতুন কারখানা যেমন হচ্ছে, তেমনি বন্ধ হয়ে গেছে অনেক চালকল। দিনাজপুরের ব্যবসা-বাণিজ্যের নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন জেলা চেম্বারের পরিচালক ও বাংলাদেশ অটো, মেজর ও হাস্কিং মিল মালিক সমিতির সহসভাপতি সাইদুর রহমান পাটোয়ারি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দিনাজপুর প্রতিনিধি রাজিউল ইসলাম।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: কৃষিনির্ভর দিনাজপুরের ব্যবসা-বাণিজ্যের এখন কী অবস্থা?
সাইদুর রহমান পাটোয়ারি: দিনাজপুর ধান-চালের জন্য প্রসিদ্ধ জেলা। প্রযুক্তি ও আধুনিকতার ছোঁয়া লাগায় এখন ধান-চালের ব্যবসার ধরন বদলাচ্ছে। এখন এ ব্যবসার সঙ্গে বড় পুঁজির করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোও যুক্ত হচ্ছে। এটা বাস্তবতা, এই বাস্তবতা আমাদের মানতেই হবে। দিনাজপুরে আগে দেড় হাজারের মতো সনাতন পদ্ধতির হাস্কিং মিল ছিল। হাস্কিং মিলের পর এসেছে মেজর টেকনোলজি। এখন এসেছে অটো চালকল। এ বিবর্তনের ফলে গত ২০ বছরে প্রায় ১ হাজার ২০০ হাস্কিং মিল বন্ধ হয়ে গেছে। নিত্যনতুন প্রযুক্তির কারণে অটো চালকলে এখন বড় ধরনের বিনিয়োগ করতে হচ্ছে। ফলে ভবিষ্যতে ধান-চালের ব্যবসার পুরোটাই চলে যাবে করপোরেটদের হাতে। যদিও এটিকে নেতিবাচকভাবে দেখার কিছু নেই।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: প্রযুক্তির এ উৎকর্ষ অব্যাহত থাকলে ক্ষুদ্র পুঁজির হাস্কিং মিল ও অটো চালকলের ব্যবসায়ীদের কী হবে, তাঁরা কোথায় যাবেন?
সাইদুর রহমান পাটোয়ারি: ইতিমধ্যে অধিকাংশ হাস্কিং মিলের ব্যবসায়ী তাঁদের পেশা পরিবর্তন করেছেন। বন্ধ হয়ে যাওয়া হাস্কিং মিলের জায়গায় গড়ে উঠেছে বিপণিবিতান, বাড়ি, ইটভাটা। এটা সময়ের সঙ্গে প্রযুক্তির বিবর্তন। গোটা বাংলাদেশে একসময় চালকল ছিল ১৬ হাজার। এখন আছে ৩ হাজারের মতো। তা–ও ভালোভাবে চলছে বড়জোর দেড় হাজার মিল। আধুনিক মেশিন স্থাপন করতে প্রয়োজন হয় কোটি টাকা। কিন্তু সেই বিনিয়োগ সবাই করতে পারেননি বা পারছেন না। তাই কেউ কেউ পেশা বদল করে এরই মধ্যে মিলমালিক থেকে সাধারণ ধান ব্যবসায়ী হয়ে গেছেন।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: দিনাজপুরকে বলা হয় ধানের জেলা। কিন্তু খাদ্য বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, এ জেলায় গত দুই বছর ধান-চাল ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। সেটি কেন?
সাইদুর রহমান পাটোয়ারি: সরকার ধান-চাল কেনে আগ্রহী মিলমালিক ও কৃষকের কাছ থেকে। মিলমালিকদের লাইসেন্স আছে, কিন্তু কৃষকের লাইসেন্স নেই। লাইসেন্স ও বিনিয়োগ বাঁচানোর স্বার্থে লোকসান গুনে হলেও মিলমালিকেরা সরকারকে চাল দেন। কিন্তু কৃষকের সে বাধ্যবাধকতা নেই। ফলে খোলাবাজারে বেশি দামে ধান বিক্রিতেই কৃষকের আগ্রহ বেশি। কৃষক ন্যায্যমূল্য বা লাভ পেলে ভোক্তাদের সেই দাম মেনে নিতে হবে। তবে এটা ঠিক, লাইসেন্সের ভয় না থাকলে আমিও সরকারকে চাল দিতাম না।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: ব্যবসায়ীরা শুধু বাজারের চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন করবেন, নাকি চালের পুষ্টিগুণের বিষয়টিও তাঁরা বিবেচনায় নেবেন?
সাইদুর রহমান পাটোয়ারি: এটা খুবই স্বাভাবিক যে যিনি বিনিয়োগ করছেন, তিনি অবশ্যই বাজারের চাহিদাকে বিবেচনায় নিয়েই বিনিয়োগ করবেন। যদি কখনো ঢেঁকিছাঁটা চালের চাহিদা তৈরি হয়, তাহলে ব্যবসায়ীরাও সে অনুযায়ী উদ্যোগ নেবেন। যেমন অরগানিক চায়ের চাহিদা তৈরি হওয়ায় চা ব্যবসায়ীরা সে খাতে বিনিয়োগ করছেন। বাজারে ঝকঝকে চকচকে চালের বাজার যেভাবে বাড়ছে, তাতে চালের পুষ্টিগুণের বিষয়টি মার খাচ্ছে। মিলে যে প্রক্রিয়ায় চাল উৎপাদিত হয়, তাতে পুষ্টিমান কমে যায়। উচ্চবিত্তরা চালের পাশাপাশি অন্যান্য পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ খাবার খেতে পারে। কিন্তু নিম্নবিত্তদের পক্ষে সেটি সম্ভব হয় না। এ কারণে গরিব মানুষের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করতে সরকার গুদামজাত চালে ‘পুষ্টি চাল’ (ক্যানেল প্রোডাকশনের মাধ্যমে উৎপাদিত) মিশ্রণ ঘটাচ্ছে। এই চাল ওএমএস, কাবিখা, টিআর প্রকল্পের মাধ্যমে দরিদ্র মানুষকে দিয়ে তাদের পুষ্টির চাহিদা পূরণের চেষ্টা করছে সরকার।
বাজারে ঝকঝকে চকচকে চালের চাহিদা যেভাবে বাড়ছে, তাতে চালের পুষ্টিগুণের বিষয়টি মার খাচ্ছে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: সরকার এখন চাল আমদানির কথা বলছে। চাল আমদানির বিষয়টাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
সাইদুর রহমান পাটোয়ারি: আমি মনে করি, ভোক্তাদের রুচির কথা বিবেচনা করে সরকার চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাধ্য না হলে এখন মোটা চাল কেউ খেতে চায় না। এদিকে মিলারদের কাছে প্রচুর অবিক্রীত ধান-চাল পড়ে আছে। মোটা চাল এখনো মিলগেটে ৩৬ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু ভোক্তাদের চাহিদা বেশি চিকন চালের। ফলে মোটা চাল অবিক্রীত থেকে যাচ্ছে। বাজারে মোটা চালের সেভাবে দাম বাড়েনি। তাই চিকন চালের সরবরাহ ঠিক রাখতেই হয়তো সরকার আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে। এটাকেও আমি ইতিবাচকভাবেই দেখি। শুধু বলব চাল আমদানি যেন বিনা শুল্কে না হয়, কিছুটা হলেও শুল্ক আরোপ করা জরুরি।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: অনেক সময় কৃষকেরা অভিযোগ করেন কীটনাশক-সার ও ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে উৎপাদন খরচ বাড়ছে। আপনিও কি তা–ই মনে করেন?
সাইদুর রহমান পাটোয়ারি: এ কথা ঠিক কীটনাশক, সার ও ডিজেলের দাম বাড়ছে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি বেড়েছে শ্রমের মূল্য। আগে যে শ্রমিক দিনে ২০০ টাকায় পাওয়া যেত, এখন ৪০০ টাকায়ও পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা শুধু সার, কীটনাশক ও ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কথা বলছি, কিন্তু শ্রমের মূল্যবৃদ্ধির কথা বলছি না। আমি মনে করি কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার পেছনে শ্রমের মূল্যবৃদ্ধি অন্যতম কারণ।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: কৃষিপ্রধান এলাকা হওয়ায় দিনাজপুরে এখনো শিল্পকারখানা বলতে শুধুই চালকল। এখানে অন্যান্য শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে না কেন?
সাইদুর রহমান পাটোয়ারি: এই তথ্য পুরোপুরি সঠিক নয়। ব্যবসা রূপান্তরিত হয়। একটা সময় আমরা ভেবেছি, যন্ত্র এলে মানুষ কাজ হারাবে। কিন্তু সেটি হয়নি, বরং প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের কাজের ক্ষেত্রও বেড়েছে। যারা প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি, তারাই হারিয়ে গেছে। দিনাজপুরে এখন কৃষিভিত্তিক শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। এ জেলায় এখন পর্যন্ত ১৪টি আলু সংরক্ষণাগার গড়ে উঠেছে। এমনও হতে পারে, কিছুদিনের মধ্যে এখানে আলুর চিপস বানানোর কারখানা হবে। একসময় এ জেলায় কোনো ফ্লাওয়ার মিল ছিল না। এখন ২০টির মতো মিল হয়েছে। ফিড মিল, পোশাক কারখানা, পরচুলার কারখানা হয়েছে। একসময় যোগাযোগ ব্যবস্থাও খুব খারাপ ছিল। গত ১০ বছরে এ ক্ষেত্রে বেশ উন্নতি হয়েছে। এখন দিনাজপুরে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্ক হচ্ছে। সামনে আরও বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হবে। আমি মনে করি গ্যাস সরবরাহ, প্লট ও বিনিয়োগের সুবিধা বাড়ানো হলে উত্তরাঞ্চলেও অনেক শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: আমরা জানি, বিরলে স্থলবন্দরের কাজ শুরু হয়েছে। এটি হলে এ এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যে কী ধরনের প্রভাব পড়বে?
সাইদুর রহমান পাটোয়ারি: আশা করছি, খুব শিগগির বিরল স্থলবন্দরটি পূর্ণাঙ্গ রূপ নেবে। এই বন্দর চালু হলে ভারত-বাংলাদেশ-নেপালের সঙ্গে রেল ও সড়ক যোগাযোগের মাধ্যমে পণ্য আনা-নেওয়া হবে। এটি একটি বহুমুখী ব্যবহার উপযোগী স্থলবন্দর হবে। বন্দরটি জেলা শহরের কাছে হওয়ায় এ এলাকার অর্থনৈতিক উন্নয়নে এটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। শুধু দিনাজপুর নয়, গোটা দেশের জন্যই এ বন্দর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: তরুণ ব্যবসায়ীদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী?
সাইদুর রহমান পাটোয়ারি: আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশে কোনো বেকার সমস্যা নেই। সমস্যা বা সংকট দক্ষ ও যোগ্য লোকের। কারও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি থাকা মানেই কিন্তু সক্ষমতা অর্জন নয়। বর্তমান যুগে সাধারণ পড়াশোনার পাশাপাশি কম্পিউটার জানাটা যেমন আবশ্যক, তেমনি পরিশ্রমী হতে হবে। আমি পড়াশোনা করেছি চাকরির জন্য—তরুণদের এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তরুণদের জীবনের লক্ষ্য ঠিক করে সেই অনুযায়ী দক্ষতা অর্জন করতে হবে। আমি মনে করি বর্তমানে উদ্যোক্তাদের জন্য দেশে স্বর্ণযুগ চলছে।