দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ সব সময় গরিব হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে বলে উল্লেখ করেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। উদাহরণ দিয়ে এ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেছেন, ‘ঝুঁকিতে থাকা মানুষের অবস্থা এমন, পানিতে সারা শরীর নিমজ্জিত রেখে নাকটা ভাসিয়ে রাখা। ঢেউ আসলে ডুবে যায়। এটা সুখকর অবস্থা নয়।’ তাঁর মতে, ঝুঁকিতে থাকা এসব মানুষের আয়ের নিরাপত্তা বাড়াতে হবে।
এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত দুই দিনব্যাপী সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশনে গতকাল সোমবার ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এসব কথা বলেন। রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে ‘মহামারি থেকে উত্তরণের পথে বাংলাদেশ: অভিজ্ঞতা অর্জন ও নীতি প্রণয়ন’ শীর্ষক এ সম্মেলন হয়।
একই অনুষ্ঠানে আরেক বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছেন, ঝুঁকিতে থাকা মানুষের ঝুঁকির মাত্রা নির্ধারণ করা উচিত। কারা কেমন ঝুঁকিতে থাকেন, সে অনুযায়ী উদ্যোগ নিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, এসব মানুষ কেন ঝুঁকিতে থাকেন, তা খুঁজে বের করতে হবে। আবার সরকারি সুবিধা কেন তাঁদের কাছে পৌঁছায় না, সমস্যা কোথায়—তা–ও চিহ্নিত করতে হবে।
সম্মেলনে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হন অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান ও ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
কারা ‘পানিতে সারা শরীর নিমজ্জিত রেখে নাকটা ভাসিয়ে’ রেখে জীবন যাপন করেন, তা উল্লেখ করেন অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি বলেন, এসব মানুষ মূলত দারিদ্র্যসীমার কিছুটা ওপরে অবস্থান করেন। ঋণ নিয়ে কিংবা আত্মীয়স্বজনের সহায়তা নিয়ে জীবন ধারণ করেন। কিন্তু করোনাকালে তাঁরা এ ঋণ বা সহায়তাও পাননি।
এই দুই জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদের এ বক্তব্য এল এমন একটা সময়ে, যখন দেশে করোনার কারণে দারিদ্র্য বেড়েছে বলে বিভিন্ন জরিপে উঠে এসেছে। এসব জরিপে বলা হয়েছে, করোনার আগে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০ শতাংশের মতো। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫ শতাংশের বেশি।
সম্মেলনে গতকাল সকালের অধিবেশনে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান একটি জরিপের ফল তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, করোনাকালে ৪০ শতাংশের বেশি কর্মজীবী মানুষের অবস্থা আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। ৮৬ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন, দৈনন্দিন জীবনের চাহিদা মেটাতে তাঁরা পর্যাপ্ত আয় করতে পারছেন না। ৭৮ শতাংশ উত্তরদাতা কোভিডের কারণে খরচ কমিয়েছেন। আর ৫২ শতাংশ পরিবারকে খাদ্যতালিকায় পরিবর্তন এনে খরচ কমাতে হয়েছে। জরিপে আরও বলা হয়, মাত্র ২০ শতাংশ পরিবার সরকারি সহায়তা পেয়েছে।
এ জরিপ করা হয় এ বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে। ২ হাজার ৬০০ মানুষকে এর আওতায় আনা হয়েছিল। জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, কোভিডের কারণে গরিবেরা আরও গরিব হয়েছে। ধনীদের আয় আরও বেড়েছে।
চার অভিলাষের সামনে বাংলাদেশ
সমাপনী অধিবেশনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তাঁর প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের সামনে এখন চারটি অভিলাষ রয়েছে—কোভিড-১৯ থেকে উত্তরণ, স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণ, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জন এবং উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া। এসব অভিলাষে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ আছে, তা–ও বলা হয় মূল প্রবন্ধে।
অভিলাষ পূরণের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে বলা হয়েছে, টিকাদান দ্রুত শেষ করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতের অভিঘাত যত দিন থাকে, এর চেয়ে বেশি সময় ধরে অর্থনৈতিক বিপন্নতা বিরাজমান থাকে। এ ছাড়া এলডিসি উত্তরণের পর বাণিজ্য সক্ষমতা ধরে রাখতে আঞ্চলিক বাণিজ্য বৃদ্ধি, মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করা এবং বৈশ্বিক পণ্য সরবরাহের নেটওয়ার্কে যুক্ত হতে হবে। মূল্যস্ফীতির চাপ ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। শ্রমিকশ্রেণির ভোগ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এসডিজি অর্জনের মূলে থাকতে হবে ‘কাউকে পেছনে রাখা যাবে না’—এ লক্ষ্য। আর উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত হতে অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হবে। অভ্যন্তরীণ বাজারমুখী শিল্প খাত গড়ে তুলতে হবে।
এ অধিবেশনে বিশেষ বক্তা সিপিডির বিশেষ ফেলো রওনক জাহান মনে করেন, কোভিড পরিস্থিতি থেকে পুনরুদ্ধার কীভাবে হবে, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হওয়া দরকার। ‘কাউকে পিছিয়ে রাখা যাবে না’—এটিই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাওয়া উচিত।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘কোভিড থেকে আমরা শিখলাম বৈষম্য ও ঝুঁকি মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।’ তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকার সক্ষমতাকে অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয়েছে।