বড়রা পেয়েছে বেশি, ছোটরা অনেক কম

কম সুদের ঋণের বড় অংশ পেয়েছে বড় শিল্পগ্রুপ। ছোটদের ঋণও গেছে ব্যবসা ও সেবা খাতে। উৎপাদন খাতের ছোট উদ্যোক্তারা ঋণের দেখা পাচ্ছে না।

  • দেশজুড়ে এখন ৭৮ লাখ কুটির ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে।

  • ঋণ বিতরণের জন্য ব্যাংকের পাশাপাশি ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা ও মোবাইল ব্যাংকিং সেবা ব্যবহারের পরামর্শ।

  • ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার মাধ্যমে প্রান্তিক উদ্যোক্তাদের কাছে ঋণ পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ।

করোনাভাইরাসের কারণে দেশের প্রায় সব খাতই ক্ষতিগ্রস্ত। ক্ষতি কাটিয়ে টিকে থাকতে প্রণোদনা প্যাকেজের অংশ হিসাবে ব্যাংকের মাধ্যমে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা ঋণের ব্যবস্থা করেছে সরকার। সরকার এই ঋণের সুদহারে ভর্তুকি দেয়। এতে সুদের হার কমে হয়েছে ৪-৫ শতাংশ। আর প্রণোদনা তহবিলের এই কম সুদের ঋণের বড় অংশই পেয়েছে বড় শিল্পগ্রুপ ও প্রভাবশালীরা।

আবার কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) খাতের জন্য বরাদ্দ করা ঋণও প্রান্তিক পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের কাছে পৌঁছাতে পারেনি। এতে কেউ কেউ ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে, আবার অনেকে ব্যবসা ছোট করে আনছে। এমন পরিস্থিতিতে অর্থনীতির গতি ধরে রাখতে আগামী বাজেটে প্রান্তিক উদ্যোক্তাদের দিকে নজর দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদেরা। আর ঋণ বিতরণের জন্য ব্যাংকের পাশাপাশি ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা ও বিকাশ-রকেট-নগদের মতো মোবাইল ব্যাংকিং সেবা (এমএফএস) ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রাহমান এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান ঠিকই ঋণ পেয়েছে। তবে ক্ষতিগ্রস্ত অতিক্ষুদ্র ও ছোট উদ্যোক্তারা বড় চাপে পড়েছেন। কেউ ব্যবসা গুটিয়ে এনেছে, কেউ ছোট করে ফেলেছে। ব্যাংকগুলো তাদের কাছে পৌঁছাতে পারছে না। তাই বিসিক, এনজিও ও এসএমই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে তাদের কাছে ঋণ পৌঁছাতে হবে।

অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে যত ঋণ

দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হলে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে কম সুদের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। প্রথমে রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানার শ্রমিক-কর্মকর্তাদের বেতন দিতে পাঁচ হাজার কোটি টাকা প্যাকেজ নেওয়া হয়, যা দুই মাসেই শেষ হয়ে যায়। পরে তা আরও বাড়ানো হয়। এরপর ধীরে ধীরে শিল্প ও সেবা খাতের জন্য ৪০ হাজার কোটি টাকা, কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) খাতের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা, রপ্তানিশিল্পের জন্য ২২ হাজার কোটি টাকা, কৃষি খাতের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা, নিম্ন আয়ের পেশাজীবীদের জন্য তিন হাজার কোটি টাকাসহ কয়েকটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। ফলে ব্যাংকগুলোর প্রণোদনা প্যাকেজ বেড়ে হয় প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা ইতিমধ্যে বিতরণ হয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত এপ্রিল পর্যন্ত সিএমএসএমই খাতের ঋণ বিতরণ হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। নিম্ন আয়ের কৃষক-ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মধ্যে ঋণ বিতরণ হয়েছে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। আর শিল্প ও সেবা খাতের জন্য প্রথম দফায় বরাদ্দ করা ঋণের প্রায় পুরোটাই বিতরণ করা হয়েছে।

আর্থিক খাত–সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যাদের সঙ্গে ব্যাংকগুলোর সুসম্পর্ক ছিল, শুধু তারাই এ ঋণ পেয়েছে। ফলে সাধারণ গ্রাহকেরা কম সুদের এই ঋণের দেখা কম পেয়েছেন। আর প্রতিটি ব্যাংকের ঋণসীমা থাকায় পছন্দের গ্রাহকের বাইরে অন্যদের দিতে পারেনি। ফলে প্রণোদনার ঋণের দেখা পেয়েছেন খুব কম গ্রাহক।

একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের পরিচালকেরা অন্য একটি ব্যাংক থেকে প্রণোদনার ঋণ নিয়েছে। ওই ব্যাংকের পরিচালকদের আমরা কম সুদের ঋণ দিয়েছি। ফলে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অন্য গ্রাহকদের ঋণ দেওয়া সম্ভব হয়নি।’

কারা বেশি পেল

প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ প্রদানসংক্রান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত শিল্প ও সেবা খাতের ৪০ হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকে বেসরকারি খাতের শিল্পগ্রুপগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ৯৬১ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে আবুল খায়ের গ্রুপ। এ ছাড়া চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপও নিয়েছে ৮৫১ কোটি টাকা, বিএসআরএম গ্রুপ নিয়েছে ৬১৯ কোটি টাকা, বসুন্ধরা গ্রুপ নিয়েছে ৬০০ কোটি টাকা ও প্রাণ গ্রুপ ৫৪০ কোটি টাকা।

এ ছাড়া খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ খাতের প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপ ৫০২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। ইস্পাত খাতের কেএসআরএম পেয়েছে ৩২৫ কোটি টাকা, জিপিএইচ ২৮৬ কোটি টাকা, এসিআই গ্রুপ পেয়েছে ৩০৪ কোটি টাকা, নাভানা গ্রুপ ২৬৮ কোটি টাকা, বেক্সিমকো গ্রুপ ২৬০ কোটি টাকা, জাবের অ্যান্ড জুবায়ের ২৩৫ কোটি টাকা, স্কয়ার গ্রুপ ২০২ কোটি টাকা এবং থারমেক্স গ্রুপ ১৯০ কোটি টাকার ঋণ পেয়েছে।

ফলে দেখা যাচ্ছে, দেশের শীর্ষ ভালো প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন এই ঋণ পেয়েছে, আবার বারবার খেলাপি হওয়া প্রতিষ্ঠানও কম সুদের এই ঋণের সুযোগ নিয়েছে। ব্যাংকের মালিকানা আছে, এমন গ্রুপও এই ঋণ থেকে বাদ পড়েনি। শুধু চলতি মূলধন হিসেবে ঋণ দেওয়ার শর্ত থাকলেও ঋণের ব্যবহার খতিয়ে দেখেনি কেউ। ফলে কম সুদের এই ঋণের টাকা কোথায় ব্যবহার করা হয়েছে, তা অজানা রয়ে গেছে।

যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছিল, ঋণখেলাপিরা এই তহবিল থেকে ঋণ নিতে পারবে না। শুধু ঋণখেলাপি নয়, তিনবারের বেশি ঋণ পুনঃ তফসিল করেছেন, এমন ব্যবসায়ীরাও এ তহবিল থেকে ঋণ পাবেন না। ঋণের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

সাবেক ব্যাংকার সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে বড় ও প্রভাবশালীরা চাপ দিয়ে ঋণ নিয়ে গেছেন। সে হিসেবে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা কোনো ঋণ পায়নি। দেশের সামগ্রিক উন্নতির জন্য তাঁদের পাশে দাঁড়ানো জরুরি ছিল। এ জন্য বাজেটে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন উদ্যোগ রাখতে হবে। তাদের কাছে ঋণ পৌঁছাতে বিকল্প চ্যানেল ব্যবহার করতে হবে। ধনীদের ঋণ দিয়ে আরও ধনী করার প্রয়োজন নেই।’

ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারিদের অবস্থা কী

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) এক প্রতিবেদনে বলছে, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২৫ শতাংশ আসে সিএমএসএমই খাত থেকে। ২০২৪ সালের মধ্যে জিডিপিতে সিএমএসএমই খাতের অবদান ৩২ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য অর্জন করতে চাইলে এসএমই বন্ড চালুর বিকল্প নেই। মোট কর্মসংস্থানের ৩৬ শতাংশ হয়েছে সিএমএসএমই খাতে। দেশজুড়ে এখন ৭৮ লাখ কুটির ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে।

তবে এসব উদ্যোক্তা কম সুদের ঋণের দেখা পেয়েছেন খুবই কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সিএমএসএমই খাতের যে ১৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে, তার বড় অংশই পেয়েছেন ব্যবসা ও সেবা খাতের উদ্যোক্তারা। উৎপাদন খাতের উদ্যোক্তারা ঋণ পাওয়ার হার খুবই কম। তবে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার মাধ্যমে নিম্ন আয়ের পেশাজীবীদের ৯ শতাংশ সুদে যে ঋণ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাতে কিছুটা সাড়া মিলেছে। এই ঋণ প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে। ৩ হাজার কোটি টাকার মধ্যে প্রায় ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বিতরণ সম্পন্ন হয়েছে। ঋণ পেয়েছেন ৩ লাখ ২৮ হাজার ২৩৮ গ্রাহক। এর মধ্যে নারী গ্রাহক ২ লাখ ৯৭ হাজার ৮২১ জন। গ্রাহকেরা গড়ে ৪২ হাজার টাকা ঋণ পেয়েছেন। এ জন্য ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার মাধ্যমে প্রান্তিক উদ্যোক্তাদের কাছে ঋণ পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

নারী উদ্যোক্তাদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব গ্রাসরুটস উইমেন এন্ট্রাপ্রেনিউরস বাংলাদেশ (এজিডব্লিউইবি) সভাপতি মৌসুমী ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনায় কঠিন সময় পার করছেন অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা। উৎপাদিত পণ্য সঠিকভাবে বাজারজাত না হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন। এমনকি অগ্রিম সরবরাহ করা পণ্যের দাম না পেয়ে অনেকেই হতাশাই ভুগছেন। সরকারি প্রণোদনার অর্থ এসব উদ্যোক্তার কাছে পৌঁছায়নি। আমরা আশা করি, বাজেটে এসব খাতের জন্য আলাদা বরাদ্দ থাকবে, যার পুরোপুরি বণ্টন ও বাস্তবায়ন হবে। যাতে করে ঘুরে দাঁড়াবেন অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা।’