রপ্তানি আয়ে কনটেইনার পরিবহন

দেশি জাহাজে কনটেইনার পরিবহনে নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। চলতি বছরে নামছে আরও চারটি নতুন জাহাজ। বর্তমানে চলছে দুটি।

এক দশক পর গত বছরের জুনের শেষে দুটি দেশি জাহাজে আমদানি-রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার পরিবহন শুরু হয়। এতে সফলতা আসায় চলতি বছরে সমুদ্রে ভাসতে চলেছে লাল-সবুজ পতাকাবাহী আরও চারটি নতুন জাহাজ।

বর্তমানে যে দুটি দেশীয় জাহাজ রপ্তানিমুখী কনটেইনার নিয়ে বিদেশে যাচ্ছে, সেগুলো কর্ণফুলী লিমিটেডের। জাহাজ দুটি পরিচালনা করছে গ্রুপটির সহযোগী প্রতিষ্ঠান এইচআর লাইনস। চালুর পর থেকে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে ওই ২টি জাহাজে ৬৬ হাজার ৩৯৬ একক কনটেইনার পরিবহন হয়েছে। এসব কনটেইনার পরিবহনের বিপরীতে ভাড়া বাবদ গ্রুপটি আয় করেছে ১ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার, যা দেশীয় মুদ্রায় প্রায় ১০২ কোটি টাকা। সমুদ্র পণ্য পরিবহন সেবা খাতের রপ্তানি আয় হিসেবে যোগ হচ্ছে তা।

এইচআর লাইনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও কর্ণফুলী লিমিটেডের পরিচালক রাইমা চৌধুরী বলেন, এক দশক পর দেশি জাহাজে বিপুল পরিমাণ কনটেইনার পরিবহন দেশের জন্য বড় অর্জন। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশীয় নাবিকদের কর্মসংস্থানও। আবার দেশীয় পতাকাবাহী হওয়ায় জাহাজ দুটি নির্ধারিত সময়েই জেটিতে ভেড়ানো ও বন্দর ছেড়ে যেতে পারছে। এর ফলে পোশাক রপ্তানিকারকেরা নির্দিষ্ট দিনেই তাঁদের পণ্য জাহাজীকরণের সুবিধা পাচ্ছেন। সেই সুবাদে বিদেশি ক্রেতারাও সময়মতো পণ্য হাতে পাচ্ছেন।

দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজকে সব সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। নতুন যারা আসবে, তারাও সুবিধা পাবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে প্রতিবছর কনটেইনার পরিবহন বাড়বে। সে জন্য এই খাতে বিনিয়োগের বড় সুযোগ রয়েছে।
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম বন্দর

দেশীয় জাহাজে কনটেইনার পরিবহনে প্রথম বিনিয়োগ করেছিল কিউসি কনটেইনার লাইন ও এইচআরসি শিপিং। ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৮ সালের মধ্যে দুই প্রতিষ্ঠান কনটেইনারবাহী জাহাজ কিনে এই কার্যক্রম শুরু করেছিল। ওই সময়ে বছরে কনটেইনার পরিবহন হতো তিন থেকে চার লাখ। কিন্তু বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ২০০৭ সালে কিউসি ও ২০১০ সালে এইচআরসি এই ব্যবসা থেকে পুরোপুরি সরে গিয়েছিল।

এরপর থেকে দেশীয় বহরে ছিল শুধু সাধারণ পণ্য ও তেল পরিবহনকারী জাহাজ। তবে কনটেইনার পরিবহন বৃদ্ধি পাওয়ায় এক দশক পর গত বছরের জুনে আবার কনটেইনার পরিবহনকারী দুটি জাহাজ সমুদ্রে ভাসায় এইচআর লাইনস। জাহাজগুলো চট্টগ্রাম থেকে সিঙ্গাপুর বন্দর ও মালয়েশিয়ার কেলাং বন্দরে আমদানি-রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার আনা-নেওয়া করে। এই দুটি জাহাজ নিয়ে এইচআর লাইনস এখন প্রতিযোগিতা করছে বিদেশি ২২টি প্রতিষ্ঠানের (ফিডার অপারেটর) ৮৪টি কনটেইনার জাহাজের সঙ্গে।

সাফল্যের দেখা পাওয়ায় কর্ণফুলী গ্রুপ তাদের জাহাজের বহর আরও বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। তাদের বহরে আরও দুটি জাহাজ যুক্ত হচ্ছে। এখন বহির্নোঙরে আছে জাহাজ দুটি। এগুলো চলবে চট্টগ্রাম থেকে শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দরে। আগামী মাসেই জাহাজ দুটির চলাচল শুরু করার কথা রয়েছে। এ ছাড়া আগামী আগস্টের মধ্যে আসবে আরও দুটি। নতুন এই ৪ জাহাজে ২২৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে গ্রুপটি। আগের বিনিয়োগসহ এই খাতে গ্রুপটির মোট বিনিয়োগ দাঁড়াবে ৩৩৫ কোটি টাকা।

কর্ণফুলী গ্রুপের পরিচালক হামদান হোসেন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা যত বাড়বে, ততই দেশের জন্য সুবিধা। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে কনটেইনার পরিবহনের প্রায় ৪ শতাংশ হচ্ছে দেশীয় জাহাজ দুটির মাধ্যমে। এই হার আগামী ২-৩ বছরে ২০-৩০ শতাংশে উন্নীত করাই আমাদের লক্ষ্য।’

বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে কনটেইনার পরিবহনের প্রায় ৪ শতাংশ হচ্ছে ২টি দেশীয় জাহাজের মাধ্যমে। আগামী ২-৩ বছরে ২০-৩০ শতাংশে উন্নীত করাই আমাদের লক্ষ্য।
হামদান হোসেন চৌধুরী পরিচালক, কর্ণফুলী গ্রুপ

বন্দর ও শিপিং খাতের তথ্য নিয়ে দেখা গেছে, গত বছর বন্দর দিয়ে ২৫ লাখ ৮৭ হাজার ইউনিট কনটেইনার পরিবহন হয়েছে। প্রতি একক কনটেইনারের গড় ভাড়া ১৮০-২০০ ডলার। সেই হিসাবে কনটেইনার ভাড়া বাবদ প্রায় চার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করেছে ফিডার অপারেটররা।

চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান বলেন, বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজকে সব সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। নতুন যারা আসবে, তারাও পাবে। প্রবৃদ্ধির সঙ্গে প্রতিবছর কনটেইনার পরিবহন বাড়বে। সে জন্য এই খাতে বিনিয়োগের বড় সুযোগ আছে। বিনিয়োগ বাড়লে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পাবে, বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।

আমদানি ও রপ্তানি পণ্যবাহী বড় আকারের কনটেইনার জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়তে পারে না। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন বন্দর থেকে বড় জাহাজে করে চট্টগ্রামমুখী কনটেইনার প্রথমে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও শ্রীলঙ্কার বন্দরে আনা হয়। সেখান থেকে ফিডার জাহাজে (ছোট-মাঝারি আকারের) করে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার আনা হয়। একইভাবে এই তিন দেশের বন্দর হয়ে রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার নেওয়া হয় ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের নানা দেশে।