সহজে টাকা চান ব্যবসায়ীরা

ব্যবসায়ীদের প্রস্তাব

  • প্রণোদনা ঋণের দীর্ঘমেয়াদি কিস্তি।

  • শিল্পকারখানার জন্য ১৫ বছর মেয়াদি ঋণ।

  • এসএমই ঋণের মেয়াদ ৭-১০ বছর।

  • লেনদেন দেখে ঋণ দেওয়া।


ব্যাংকের প্রস্তাব

  • খেলাপি ঋণ আদায়ে সহায়তা।

  • ঋণের টাকা সঠিক সময়ে ফেরত।

  • ৯% সুদে ছোটদের ঋণ দেওয়া কঠিন।

  • সুদহার হবে বাজারভিত্তিক।

ছবি: সংগৃহীত

ব্যবসায়ীরা ব্যাংকারদের ডেকেছিলেন ঋণের মাশুল, সহজ শর্তে ঋণ গ্রহণ, এসএমই খাতে ঋণ বাড়ানো এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বিষয়ে আলোচনার জন্য। পাশাপাশি প্রণোদনার ঋণ পরিশোধে বাড়তি সময়ও চান কেউ কেউ। ব্যবসায়ীদের এসব দাবির বিষয়ে সঠিক জবাব না দিয়ে বরং খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যবসায়ীদের সহায়তা চেয়েছেন শীর্ষ ব্যাংকাররা।

দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) সঙ্গে শীর্ষ ব্যাংকারদের সভায় এমন আলোচনা হয়। দীর্ঘদিন পর ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে এ সভা হয় রাজধানীর বনানীর হোটেল শেরাটনে। সভায় ৩২টি দেশি-বিদেশি ব্যাংকের এমডি উপস্থিত ছিলেন। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে অনুষ্ঠিত এ আলোচনার বিষয় ছিল ‘বিরাজমান পরিস্থিতিতে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় ব্যাংকিং খাতের ভূমিকা: সমস্যা ও সম্ভাবনা’।

দীর্ঘদিন পর ব্যাংকের এমডি ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে এ সভা হয় রাজধানীর একটি হোটেলে। সভায় ৩২টি দেশি-বিদেশি ব্যাংকের এমডি উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, ‘শিল্পকারখানার জন্য ১৫ বছর মেয়াদি ঋণ দরকার। কিন্তু তা ব্যাংক থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। নতুন করে ৩০ থেকে ৩৫টি সুতার মিল হচ্ছে। এসব ঋণের মেয়াদ দীর্ঘমেয়াদি না হলে সব খেলাপি হয়ে পড়বে।’

স্বাগত বক্তব্যে এফবিসিসিআই সভাপতি বেশ কিছু দাবি তুলে ধরেন। এর মধ্যে রয়েছে এসএমই ঋণে ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম সহজ করা, এসএমই খাতে মেয়াদি ঋণের মেয়াদ ৭-১০ বছর করা, খেলাপি হওয়ার পর সুদ আরোপ না করা, ঋণ পুনঃ তফসিলে এককালীন জমা ১-২ শতাংশে সীমিত রাখা ইত্যাদি।

সভায় এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি পাশে বসে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ইস্টার্ণ ব্যাংকের এমডি আলী রেজা ইফতেখার বলেন, ‘প্রণোদনা ঋণ, কোনো অনুদান নয়। ঋণের টাকা সঠিক সময়ে ফেরত আনা ব্যাংকের দায়িত্ব। আর ছোট উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে সময় লাগছে। কারণ, ব্যাংকগুলো যাচাই-বাছাই করে ঋণ দিচ্ছে। ৯ শতাংশ সুদে ছোটদের ঋণ দেওয়া অনেক চ্যালেঞ্জিং। কারণ, খরচ অনেক বেশি।’

আলী রেজা ইফতেখার আরও বলেন, ‘খেলাপি ঋণ পুরো খাতকে ক্ষতিতে ফেলেছে। ঋণ খারাপ হলে তা আদায় করতে ১০ বছর সময় লেগে যাচ্ছে। আমানতকারীদের থেকে তো টাকা ফেরত দিতে ১০ বছর সময় নেওয়া যাচ্ছে না। আবার খেলাপি ঋণ আদায়ে আইনি খরচ কত লাগছে, তা আপনারা জানেন না।’

১০ জন খেলাপি ব্যবসায়ীর জন্য বাকি ৯০ জন ব্যবসায়ী ক্ষতিতে পড়তে পারেন না।
জসিম উদ্দিন, সভাপতি, এফবিসিসিআই

এবিবির সেক্রেটারি ও সিটি ব্যাংকের এমডি মাসরুর আরেফিন বলেন, ‘ব্যাংক মুনাফা করতে না পারলে ঋণ দিতে পারবে না। ব্যাংকের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। আবার সব ঋণের সুদহারও এক হতে পারে না। ঋণের খরচের ওপর নির্ভর করে সুদ ঠিক করা দরকার। খরচের চেয়ে সুদহার কম হওয়ায় ব্যাংকগুলো ঋণ না দিয়ে ট্রেজারি বিল-বন্ডে টাকা খাটাচ্ছে। এখন যেভাবে বিভিন্ন সেবা মাশুল নির্ধারণ করে দেওয়া হচ্ছে, তাতে ব্যাংক খাতের আয় ১২ থেকে ১৩ শতাংশ কমে যাবে।’

ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, ‘এখন কোথাও জামানতের ওপর ঋণ দেওয়া হয় না, তাই লেনদেনের ওপর ভিত্তি করে ঋণ দিতে পারে ব্যাংক। ব্যাংকগুলো ছোট ব্যবসায়ীদের ঋণ দিতে না পারলে ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে তা জানিয়ে দেওয়া উচিত। এ ছাড়া ছোটদের ঋণের মেয়াদ ৩ থেকে ৫ বছর না করলে খেলাপি হয়ে পড়বে।’

বহুজাতিক এইচএসবিসি বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী মাহবুবউর রহমান বলেন, ‘জাহাজ ভাড়ায় এখন উদ্যোক্তাদের অনেক টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। সরকার নীতি সহায়তা দিলে দেশীয় উদ্যোক্তারা এই খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে। ট্রেড অ্যান্ড লজিস্টিকে এখন বড় বিনিয়োগের সুযোগ এসেছে।’

বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, ‘রপ্তানি বিলে সব ব্যাংকের সুদ এক হওয়া উচিত।’ জবাবে এবিবির চেয়ারম্যান আলী রেজা ইফতেখার বলেন, ‘সুদহার তো নির্দিষ্ট হওয়া উচিত না। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে এটা বাজারভিত্তিক থাকাই ভালো।’

বহুজাতিক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী নাসের এজাজ বিজয় বলেন, ‘এসএমই ঋণে ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমের টাকা যাতে ব্যাংকগুলো দ্রুত পেতে পারে, সেই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।’

লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়ার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি সায়ফুল ইসলাম বলেন, ‘একটি গ্রুপের এক কোম্পানি খেলাপি হলে ওই গ্রুপের অন্য কোনো কোম্পানিকে ঋণ দেওয়া হচ্ছে না। এতে গ্রুপের পুরো ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’

প্রিমিয়ার ব্যাংকের এমডি এম রিয়াজুল করিম বলেন, ‘প্রণোদনার ঋণের মেয়াদ এক বছর। এ মেয়াদ শেষ হয়ে আসছে। গত এক সপ্তাহে ১৫-২০ জন ঋণগ্রহীতা এর মেয়াদ বাড়াতে আবেদন করেছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশনা না দিলে আমরা এই খাতে ১৩০০ কোটি টাকা ঋণ দিতাম না। ঋণ আদায়ে মন্থরতা এলে দ্বিতীয় ধাপে প্রণোদনার ঋণ দেওয়া যাবে না।’

আইএফআইসি ব্যাংকের এমডি শাহ আলম সারওয়ার ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বলেন, ‘ব্যবসা ধরে রাখতে পরবর্তীতে কারা হাল ধরবেন, তা এখনই ঠিক করা প্রয়োজন।’

খেলাপি ঋণ পুরো খাতকে ক্ষতিতে ফেলেছে।
আলী রেজা ইফতেখার, চেয়ারম্যান, এবিবি ও এমডি, ইস্টার্ণ ব্যাংক

ইসলামী ব্যাংকের এমডি মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা বলেন, ‘কৃষি ও এসএমই খাতে সুদ ভিন্ন হওয়ায় আমরা চাপে আছি। কারণ, এসএমই খাতের অনেকেই কৃষিভিত্তিক।’

ম্যাক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ আলমগীর বলেন, ‘সময় এসেছে যাঁরা খারাপ গ্রাহক, তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর। এ সময়ে ব্যাংকগুলো যদি মুনাফার চিন্তা করে, তাহলে চলবে না।’

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘যারা ইচ্ছাকৃত খেলাপি, ব্যবসা করে মুনাফা করছে, তাদের বিষয়ে আমাদের কাজ করার সুযোগ আছে।’

এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক প্রীতি চক্রবর্তী বলেন, ‘করোনার ১৮ মাসে আমাদের ব্যবসায় অনেক খারাপ সময় গেছে। প্রণোদনা তহবিল থেকে যে ঋণ পাওয়া গেছে, সেই ঋণে ৩ বছর গ্রেস পিরিয়ড দিয়ে ১০-১৫ বছরে কিস্তিতে শোধ করার সুযোগ দিলে ভালো হয়।’

অপর পরিচালক নাদিয়া বিনতে আমিন বলেন, ‘নারী উদ্যোক্তারা ঋণখেলাপি হয় না, এরপরও ঋণ পাচ্ছে না।’

ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হুমায়রা আজম বলেন, ‘আপনারা ঋণ পরিশোধে দীর্ঘমেয়াদি সময় চাইছেন। অথচ প্রণোদনার ঋণের মেয়াদ এক বছর। ঋণ পরিশোধে বাড়তি সময় চাইছেন, কিন্তু আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে বাড়তি সময় চাওয়া কি সম্ভব?’

রূপালী ব্যাংকের এমডি ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ বলেন, খেলাপি ঋণ আদায় নিয়ে এমন একটা সভার আয়োজন করতে পারে এফবিসিসিআই। এতে সব ব্যাংকের খুব উপকার হবে।

চ্যানেল আইয়ের পরিচালক শাইখ সিরাজ বলেন, ‘কৃষি খাতে গ্রুপভিত্তিক ঋণ দিতে পারে ব্যাংকগুলো।’

এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, ১০ জন খেলাপি ব্যবসায়ীর জন্য বাকি ৯০ জন ব্যবসায়ী ক্ষতিতে পড়তে পারেন না। আমরা খেলাপিদের পক্ষে নেই।’