সুগন্ধি চালের উৎপাদন ও চাহিদা বাড়ছে, দামও চড়া

সুগন্ধি ধান শুকানোর ঝামেলা কম। আবার দীর্ঘ সময় সংরক্ষণও করা যায়। কৃষকেরা নিজেরাই এসব ধান সংরক্ষণ করেন, বাজার বাড়তি হলে ছেড়ে দেন।

বিত্তবান কিংবা মধ্যবিত্তদের বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানে পোলাও, বিরিয়ানি, ফিরনি, পায়েস থাকেই, আর সেই আয়োজনের মূল উপকরণ সুগন্ধি চাল। শুধু মধ্যবিত্ত নয়, নিম্নবিত্ত মানুষেরাও অতিথি আপ্যায়নে সুগন্ধি চাল ব্যবহার করেন। হোটেল–রেস্তোরাঁতেও সুগন্ধি চালের ব্যবহার বেড়েছে। সব মিলিয়ে সুগন্ধি চালের চাহিদা ঊর্ধ্বমুখী। তবে চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দামও বাড়ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, মোটা-চিকন সব ধরনের চালের দাম ওঠানামা করলেও সুগন্ধি চালের দাম সব সময় ঊর্ধ্বমুখী।

ধানের জেলা হিসেবে খ্যাতি আছে দিনাজপুরের। বোরো কিংবা আমন, প্রতি মৌসুমেই ধান উৎপাদনে দিনাজপুর শীর্ষ জেলাগুলোর একটি। প্রাকৃতিক কারণে এখানে কাটারিভোগ ধানের ফলন বেশি হয়। চাহিদা বেড়ে যাওয়া ও লাভ বেশি হওয়ায় কৃষকেরাও সুগন্ধি ধান চাষে ঝুঁকছেন। এখানকার উৎপাদিত বাদশাভোগ, কালিজিরা, চিনিগুঁড়া (ব্রি-৩৪), কাটারিভোগ, জিরা নাজির, পাইজাম ও বাংলামতি চালের কদর এখন বিশ্বজোড়া। ইতিমধ্যে দিনাজপুরের কাটারিভোগ ও কালিজিরা চাল জিওগ্রাফিক্যাল আইডেনটিফিকেশন (জিআই) পেয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্বও করছে।

দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এক সময় কৃষকেরা অন্যান্য ধানের পাশাপাশি স্বল্প পরিমাণ জমিতে ব্রি ধান-৩৪, জিরা কাটারি, চল্লিশাজিরা, বাদশাভোগ, কালিজিরা, জটা কাটারি ও কাটারিভোগ ধানের আবাদ করতেন। ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে বাড়তে থাকে সুগন্ধি ধানের আবাদ। সে বছর উৎপাদিত হয় ৮৬ হাজার ৯৯৪ মেট্রিক টন সুগন্ধি চাল। এরপর ধারাবাহিকভাবে সুগন্ধি ধানের আবাদ ও উৎপাদন বেড়েছে। সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে উৎপাদিত হয়েছে ২ লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন চাল।

দিনাজপুর শহরের বড়বন্দর এলাকায় তিন পুরুষ ধরে চালের ব্যবসা করছেন এ কে দাস ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী অসীম কুমার দাস। তিনি জানান, এখনো হাসকিং মিলে সনাতন প্রক্রিয়ায় শুধু সুগন্ধি চাল উৎপাদন করেন তিনি। সম্প্রতি খুচরা বিক্রির পাশাপাশি অনলাইনেও চাল বিক্রি করছেন তিনি। প্রতিদিন গড়ে ৩০ মণেরও বেশি চাল বিক্রি হয় তাঁর। দোকানে ঝোলানো মূল্য তালিকা অনুযায়ী খুচরায় প্রতি কেজি বাদশাভোগ চাল বিক্রি হচ্ছে ১২০, কালিজিরা ১১০, চিনিগুঁড়া ১০০, কাটারিভোগ ১০০, সিদ্ধ কাটারি ৯৫, সিদ্ধ জিরা নাজির ৭২, সিদ্ধ পাইজাম ৬৮, সিদ্ধ বাংলামতি ৭২ টাকা দরে। চটের বস্তায় ১ থেকে ৫০ কেজি পর্যন্ত চাল প্যাকেটজাত করে বিক্রি করছেন তিনি।

অসীম কুমার আরও বলেন, শৌখিন মানুষের খাবার এই সুগন্ধি চাল। মাস দুয়েক আগেও এসব চাল কেজিতে ৫-১০ টাকা কমে বিক্রি হয়েছে। বছরখানেক আগে সুগন্ধি চাল বিক্রি হতো প্রতি কেজি ৮০ থেকে ৮৫ টাকায়। অবশ্য করোনাকালে বিভিন্ন অনুষ্ঠান কম থাকায় বিক্রি কম ছিল। গুদামে চাল পড়ে ছিল অনেক মিল মালিকের। মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ধান পাওয়া যায় না। তবে এসব ধান শুকানোর ঝামেলা কম। আবার দীর্ঘসময় সংরক্ষণও করা যায়। ফলে অধিক লাভের আশায় কৃষকেরা নিজেরাই এসব ধান সংরক্ষণ করেন, বাজার বাড়তি হলে ছেড়ে দেন।

অসীম কুমারের দোকান থেকে কাটারিভোগ চাল কেনেন ঢাকা থেকে আসা আলভী আক্তার (৩৮)। ব্যাংকে চাকরি করেন তিনি। দিনাজপুরে বেড়াতে এসেছেন। এখানকার কাটারিভোগ চালের খ্যাতির কথা শুনেছেন সহকর্মীদের কাছে। জানান, ফেবার পথে দিনাজপুর থেকে মায়ের জন্য উপহার হিসেবে কাটারিভোগ চাল নিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

সদর উপজেলার ফাসিলাডাঙ্গা এলাকার কৃষক রায়হান আলী (৪৫) গত আমন মৌসুমে আট বিঘা জমিতে জিরা নাজির ও চিনিগুড়া চালের আবাদ করেন। রায়হান জানান, প্রতি বিঘা জমিতে ধান কাটা ও মাড়াই পর্যন্ত তাঁর খরচ হয়েছে ১৯ হাজার টাকা। ধান পেয়েছেন ১৬ মণ। প্রতি মণ ধান বিক্রি করেছেন ১ হাজার ৭০০ টাকায়। হিসাব অনুযায়ী, তাঁর লাভ হয়েছে ৮ হাজার ২০০ টাকা। রায়হান বলেন, বর্তমানে সেই ধানের বাজার চলছে ২ হাজার ২০০ টাকা মণ। কিছু দিন পরেই এই ধান প্রতি মণ আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি হবে।

কখন কীভাবে এ জেলায় কাটারিভোগ চালের উৎপাদন শুরু হয়েছিল, তা জানা যায় না। তবে এই চাল ঘিরে স্থানীয়ভাবে প্রচলিত আছে নানা লোককথা। স্থানীয় লোকজন বলেন, এই ধানের চাল দিয়েই দেবতাকে প্রসাদ বা ভোগ দেওয়ার রীতি আছে বলেই এর নাম হয়েছে ‘কাটারিভোগ’। দিনাজপুরের রাজা প্রাণনাথ মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের দরবারে যাওয়ার সময় বিভিন্ন উপঢৌকনের পাশাপাশি কাটারিভোগ চাল সঙ্গে নিয়েছিলেন। চাল পেয়ে সম্রাট খুশি হয়ে প্রাণনাথকে রাজা উপাধি দেন। সেই থেকে এখনো এ জেলার মানুষ আত্মীয়স্বজনকে খুশি করতে উপঢৌকন হিসেবে পাঠান কাটারিভোগ চাল।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, এই চাল এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।