স্বজনতোষী পুঁজিবাদে বৈষম্য আরও বাড়ে

দেশের উন্নয়ন কৌশলে জাপানের মডেলকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি উল্লেখ করে অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, জাপানে বৈষম্য কম।

ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ

স্বজনতোষী পুঁজিবাদ অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর অনেক অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। বড় অংশের মানুষ দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু উন্নয়নের সঙ্গে বৈষম্য বেড়েছে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) বার্ষিক উন্নয়ন সম্মেলনের শেষ দিনে গতকাল শুক্রবার এসব কথা বলেন অর্থনীতিবিদ ও ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি ছিলেন এই সম্মেলনের শেষ অধিবেশনের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপক।

তিন দিনের এই সম্মেলনে দেশি-বিদেশি গবেষক ও অর্থনীতিবিদেরা সশরীর ও ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে অংশ নেন। ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে অংশ নিয়ে উপস্থাপিত প্রবন্ধে বলেন, উন্নয়ন মডেল হিসেবে বাংলাদেশ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকে বেশি অনুসরণ করেছে। কিন্তু দেশের উন্নয়ন সাহিত্যে জাপানকে তেমন একটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। জাপানের প্রবৃদ্ধি অনেক বেশি সমতামূলক। দেশটি সব সময় শ্রমিকদের কল্যাণের বিষয়টি মাথায় রেখে নীতি প্রণয়ন করেছে। সে জন্য যুক্তরাষ্ট্রে শতকোটি ডলারের মালিক যেখানে ৬৭৫ জন, জাপানের মাত্র ২৫ জন। এমনকি ভারতেও শতকোটি ডলারের মালিক ১৫৩ জন। অর্থাৎ জাপানে বৈষম্য কম।

প্রবন্ধে ব্যবসার পরিবেশ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ প্রতিযোগিতামূলক বাজার অর্থনীতি ও নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়ার নীতির মধ্যে পার্থক্য টানেন। তিনি বলেন, হাতে গোনা কিছু গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়া হলে তা স্বজনতোষণের পুঁজিবাদে (ক্রনি ক্যাপিটালিজম) পর্যবসিত হতে পারে। এতে বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পায়।

ঢাকা মহানগরের অতি বৃদ্ধি নিয়ে তিন দিনের সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছিলেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) পরিচালক আহমাদ আহসান। তিনি বলেছিলেন, ঢাকা মহানগরের অতি বৃদ্ধির কারণে জিডিপির ৬ থেকে ১০ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু অনেকটা ছাইভস্মের মধ্যে মানিক রতন খোঁজার মতো এর মধ্যেও ভালো দিক খোঁজেন ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। নগরের অতি ঘনত্বকে তিনি ঘনত্ব সুবিধায় রূপান্তরিত করার পরামর্শ দিয়ে বলেন, সারা দেশকে শহরের মতো করে করে গড়ে তুলতে হবে। এতে দূরত্ব ঘুচে যাবে, সরবরাহ ব্যবস্থার সব উপাদান আরও কাছাকাছি আসবে। ফলে অবকাঠামোর সর্বোত্তম ব্যবহার করা যাবে। তবে সে জন্য ভালো পরিকল্পনা দরকার।

স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে বলে উল্লেখ করে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, সে জন্য এখন থেকেই তা মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতে হবে। বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো ইতিমধ্যে বিভিন্ন আঞ্চলিক মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করেছে। মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করতে সময় ও বিশেষজ্ঞ জ্ঞান প্রয়োজন হয়। তিনি আরও বলেন, সরকার একটি ভুল প্রায়ই করে থাকে। সেটা হলো মুক্তবাণিজ্য চুক্তিবিষয়ক আলোচনায় ব্যবসায়ীদের ওপর বেশি নির্ভর করা।

তিন দিনের সম্মেলনের গতকাল শেষ দিনের অধিবেশনে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির প্রমুখ।

দেশের অর্থনৈতিক বিকাশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে কর্মসংস্থান বাড়ছে না এবং কৃষি খাতের পাশাপাশি তৈরি পোশাক খাতেও এ ধারা দেখা যাচ্ছে—আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এই পর্যবেক্ষণ নিয়ে মসিউর রহমান বলেন, দেশে এক ইউনিট বিনিয়োগের বিপরীতে এখন শূন্য দশমিক ৬ ইউনিটের মতো কর্মসংস্থান হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ অনেক বাড়াতে হবে। দেশের ভেতর থেকে এত বিনিয়োগ হওয়া কঠিন। সে জন্য বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

দেশীয় ব্যবসায়ীদের অতিমাত্রায় সুরক্ষা দিয়ে রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব কি না, এ নিয়ে অর্থনীতিবিদদের আলোচনার প্রেক্ষাপটে মসিউর রহমান বলেন, নতুন দেশে সুরক্ষা দিতে হয়, কিন্তু বেশি দিন সুরক্ষা দিলে বুঝতে হবে সমস্যা আছে।

কর্মসংস্থান নিয়ে আলোচনায় অংশ নিয়ে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, এর জন্য দরকার শিক্ষা। কিন্তু দেশের অনেক শিক্ষিত মানুষ কাজ পান না। বাজারে যে ধরনের কাজের চাহিদা আছে, সেই ধরনের কাজের দক্ষতা অনেকেরই নেই। দেশে এখন তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেশি। এটা একটা দেশের জন্য আশীর্বাদ। তিনি বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান উন্নয়নের পেছনে এই তরুণ জনেগাষ্ঠীর ভূমিকা আছে। কিন্তু আগামী দুই দশক পরে আর সেই সুবিধা থাকবে না। তাই বাজারের চাহিদার সঙ্গে শিক্ষার সমন্বয় থাকা দরকার।

এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দিয়ে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে ধনী দেশ হতে চায়। আর সে বছর থেকেই দেশে তরুণ জনেগাষ্ঠীর সংখ্যা কমতে শুরু করবে।