এক মাসে গ্রাহক ১৩ হাজার, সাড়া নেই প্রবাস কর্মসূচিতে

গতকাল রোববার সকাল পর্যন্ত ১২ হাজার ৮৮৯ জন গ্রাহক চাঁদা পরিশোধ করেছেন। এখন পর্যন্ত বেশি সাড়া প্রগতি কর্মসূচিতে।

সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নিবন্ধন করে গতকাল রোববার সকাল পর্যন্ত ১২ হাজার ৮৮৯ জন বাংলাদেশি চাঁদা পরিশোধ করেছেন। গত ১৭ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই পেনশন কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এরপর এক মাসে নতুন এই কর্মসূচির প্রতি যে সাড়া পাওয়া গেছে, বিশ্লেষকেরা তাকে ‘যথেষ্ট নয়’ বলে বর্ণনা করেছেন।

বহুল প্রতীক্ষিত এ কর্মসূচির উদ্বোধনের দিন থেকেই সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়। সেদিনই জাতীয় পেনশন কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হতে অন্তত ৮ হাজার মানুষ অনলাইনে নিবন্ধন করেছিলেন। এর মধ্যে ১ হাজার ৭০০ জন আবেদনের পুরো প্রক্রিয়া শেষ করে সেদিন চাঁদা পরিশোধ করেন।

মানুষ এখন মূল্যস্ফীতির চাপে রয়েছে, ফলে নতুন একটি কর্মসূচিতে যেতে চাইছে না। কিস্তি দিতে গেলে বর্তমান  পরিস্থিতিতে তার ওপর একধরনের বোঝা তৈরি হবে।
এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা

জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে বলেন, পেনশন কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হতে অনেকে নিবন্ধন করলেও চাঁদা পরিশোধকারীদের সংখ্যা গতকাল সকাল পর্যন্ত ছিল ১২ হাজার ৮৮৯ জন। কর্মকর্তারা বলেন, যাঁরা কিস্তির চাঁদা পরিশোধ করেছেন, কেবল তাঁরাই পেনশন কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছেন বা এনরোলমেন্ট করেছেন বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে।

গত এক মাসে পেনশন স্কিমে সব মিলিয়ে ৭ কোটি ৫৮ লাখ ৭১ হাজার টাকার কিস্তি পরিশোধ করা হয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

অর্থ বিভাগের মতে, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কথা বিবেচনায় নিয়ে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। শুরুতে চার শ্রেণির জনগোষ্ঠীর জন্য চার ধরনের পেনশন কর্মসূচি চালু করা হয়। এগুলোর নাম হচ্ছে প্রগতি, সুরক্ষা, সমতা ও প্রবাসী। এর মধ্যে বেসরকারি খাতের চাকরিজীবীদের জন্য ‘প্রগতি’, স্বকর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য ‘সুরক্ষা’, প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য ‘প্রবাসী’ এবং দেশের নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য ‘সমতা’ শীর্ষক কর্মসূচি চালু করা হয়।

‘এখন পর্যন্ত যাঁরা চাঁদা পরিশোধ করেছেন, তাঁরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তা দিয়েছেন। মানুষের মধ্যে উৎসাহ আছে। তবে যেকোনো বার্তা মানুষের কাছে যেতে খানিকটা সময় লাগে। আমরা চেষ্টা করছি যাতে সর্বজনীন পেনশন স্কিম সম্পর্কে আরও বেশি তথ্য মানুষের মধ্যে বিতরণ করা যায়।’
গোলাম মোস্তফা, জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য

এই চার কর্মসূচির মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাড়া পাওয়া গেছে প্রগতি কর্মসূচিতে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বেসরকারি চাকরিজীবীদের এই কর্মসূচির জন্য ৬ হাজার ১৭৮ জন চাঁদা পরিশোধ করেছেন। এরপর বেশি সাড়া পেয়েছে সুরক্ষা কর্মসূচি। এক মাসে ৪ হাজার ৯৯০ জন এই কর্মসূচিতে নাম লিখিয়েছেন। সমতা কর্মসূচির জন্য চাঁদা পরিশোধ করেছেন ১ হাজার ৩২৬ জন। আর সবচেয়ে কম সাড়া পড়েছে বিদেশে বাস করেন এমন বাংলাদেশিদের কর্মসূচি প্রবাসের ক্ষেত্রে। মাত্র ৩৯৫ জন এই পেনশন কর্মসূচিতে চাঁদার কিস্তি দিয়েছেন।

সবার জন্য চালু করা পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হতে ইউপেনশন ওয়েবসাইটে গিয়ে নিবন্ধন করতে হয়। এ ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বা পাসপোর্ট নম্বর, একটি সচল মুঠোফোন নম্বর, ব্যাংক হিসাব নম্বর, নমিনির এনআইডি ইত্যাদি তথ্য লাগে।

চাঁদা দিয়ে পেনশন-ব্যবস্থার আওতায় আসতে পারেন ১৮ বছরের বেশি বয়সী যে কেউ। দেশের অন্তত ১০ কোটি মানুষ পেনশনব্যবস্থার আওতায় আসবেন এমন প্রত্যাশা সরকারের রয়েছে। বিশাল একটি জনগোষ্ঠীকে সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় আনা এবং নিম্ন আয় ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত সমাজের ৮৫ শতাংশ মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েই পেনশন স্কিম চালু করা হয়।

বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ এখন কোনো ধরনের পেনশনব্যবস্থার বাইরে রয়েছেন। সে কারণে ধারণা করা হয়েছিল যে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের মতো একটি সামাজিক সুরক্ষামূলক কর্মসূচিতে বেশ দ্রুত সাড়া পাওয়া যাবে। কিন্তু এক মাস সময়ে খুব বেশি মানুষ সর্বজনীন পেনশন স্কিমে যোগ দেননি। পেনশন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা অবশ্য মনে করেন, এ ধরনের একটি কর্মসূচির মূল্যায়নের জন্য এক মাস খুব বেশি সময় নয়।

জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত যাঁরা চাঁদা পরিশোধ করেছেন, তাঁরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তা দিয়েছেন। মানুষের মধ্যে উৎসাহ আছে। তবে যেকোনো বার্তা মানুষের কাছে যেতে খানিকটা সময় লাগে। আমরা চেষ্টা করছি যাতে সর্বজনীন পেনশন স্কিম সম্পর্কে আরও বেশি তথ্য মানুষের মধ্যে বিতরণ করা যায়।’

সরকার অবশ্য মনে করছে পেনশন স্কিম নিয়ে নেতিবাচক প্রচার রয়েছে। গত ২৮ আগস্ট মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে সর্বজনীন পেনশন নিয়ে জনগণ যাতে কোনো অপপ্রচারে প্রভাবিত না হয়, সেদিকে নজরদারি রাখতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বৈঠকের পর মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, সর্বজনীন পেনশন মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। কিন্তু অনেকেই ঐতিহাসিক এ উদ্যোগের বিপক্ষে অপপ্রচার চালাচ্ছে। তাই প্রধানমন্ত্রী প্রকৃত তথ্য, সরকার কী করেছে, কী করতে যাচ্ছে, কীভাবে মানুষ উপকৃত হবে—এ ব্যাপারগুলো জনগণের কাছে উপস্থাপন করার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশ দিয়েছেন।

এরপর জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গিয়ে পেনশন কর্মসূচি সম্পর্কে আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। তবে এই কর্মসূচি সম্পর্কে মানুষের একধরনের আস্থাহীনতা এখনো রয়েছে। বিশেষ করে সর্বজনীন পেনশন স্কিম থেকে সরকার ঋণ নিতে পারে, সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রীর এমন বক্তব্যে আস্থাহীনতা বেড়েছে বলে মনে করা হয়।

মানুষের মধ্যে আস্থাহীনতা যে রয়েছে, সেটা মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, সরকার পেনশনের টাকা ফেরত দিতে পারবে কি না, তা নিয়েই এই আস্থাহীনতা। তাঁর মতে, সর্বজনীন পেনশনের এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়, তবে মূল চ্যালেঞ্জ হলো এর বাস্তবায়ন।

তবে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান মনে করেন, পেনশন স্কিম সম্পর্কে ধীরে ধীরে মানুষের আগ্রহ বাড়বে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘যেকোনো বিষয়ে প্রথম দিকে মানুষের আগ্রহ একটু কম থাকে। প্রথম প্রথম একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে। সর্বজনীন পেনশন স্কিমেও তা-ই হয়েছে। এটা তেমন কিছু না।’

পেনশন তহবিল থেকে ঋণ নেওয়া প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। সঞ্চয়পত্র বিক্রি করেও সরকার ঋণ নিচ্ছে। পেনশন তহবিল থেকেও ঋণ নিতে পারে। এতে ভয়ের কিছু নেই এবং আইনি কোনো বাধা নেই।’

এখন পর্যন্ত যে সাড়া পাওয়া গেছে, তাকে যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, মানুষ এখন মূল্যস্ফীতির চাপে রয়েছে, ফলে নতুন একটি কর্মসূচিতে যেতে চাইছে না। কিস্তি দিতে গেলে বর্তমান পরিস্থিতিতে তার ওপর একধরনের বোঝা তৈরি হবে। অন্যদিকে প্রবাস স্কিমে সবচেয়ে কম সাড়া পাওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, ডলারের আনুষ্ঠানিক মূল্য এখনো বাজারমূল্যের চেয়ে কম। সুতরাং ডলারে কিস্তি দিলে আর্থিক ক্ষতি হতে পারে—হয়তো অনেকে মনে করছেন।