৪৮% কৃষি জমি ইজারার অধীনে

স্বপন আদনান বলেন, গ্রামীণ সমাজের নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনেও বৈচিত্র্য আসছে। স্রেফ কৃষিশ্রমিক হিসেবে কাজ করে তাঁদের আর পোষাচ্ছে না।

প্রথম আলো ফাইল ছবি

কৃষিজমির মালিকেরা আগে মূলত বর্গাচাষিদের হাতে চাষাবাদের ভার ছেড়ে দিতেন, তা সত্ত্বেও চাষাবাদের সঙ্গে তাঁদের কিছুমাত্রায় সম্পৃক্ততা থাকত। কিন্তু গত কয়েক বছরে দেশের কৃষিতে নাটকীয় পরিবর্তন এসেছে। এখন নির্ধারিত মূল্যে কৃষিজমি ঠিকাদারদের কাছে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। চাষের সঙ্গে জমির মালিকের সম্পর্কই থাকছে না।

একই সঙ্গে দেখা যাচ্ছে, বড় বড় গ্রামীণ পরিবার বা জমির মালিকদের সম্পদ ও আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, নানা ধরনের কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন তাঁরা। জমির ইজারা দিয়ে তাঁরা অর্থ পাচ্ছেন, তাঁরাই আবার রাইস মিল দিচ্ছেন, শহরে বাড়ি-গাড়ি কিনছেন। আরেক দিকে গ্রামীণ সমাজের একদম নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনেও বৈচিত্র্য আসছে। শুধু কৃষিশ্রমিক হিসেবে কাজ করে তাঁদের আর পোষাচ্ছে না। তাঁরা শহরে যাচ্ছেন, বিভিন্ন ধরনের কাজে যুক্ত হচ্ছেন। তবে মধ্যম শ্রেণির জীবনে বিশেষ পরিবর্তন আসেনি।

ভূমিহীন চাষিরা নানা সীমাবদ্ধতার কারণে হয়তো বড় ধরনের উৎপাদনে যেতে পারবেন না। আবার তাঁদের মধ্যে শিক্ষিত মানুষের আবির্ভাব ঘটলে বাণিজ্যিক কৃষির সম্ভাবনা তৈরি হবে
বিনায়ক সেন, মহাপরিচালক, বিআইডিএস

গতকাল বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত এক সেমিনারে এসব কথা বলেন অর্থনীতিবিদ স্বপন আদনান। ‘কৃষির ক্রান্তিকাল বা গ্রামীণ রূপান্তর: গ্রামীণ বাংলাদেশের পরিবর্তনের কারণ ও ধারা’ শীর্ষক সেমিনারে এসব কথা বলেন তিনি।

সেমিনারে দেশের কৃষি খাতে পরিবর্তনের বিশদ চিত্র পেশ করেন স্বপন আদনান। বলেন, এত পরিবর্তনের মধ্যে ইতিবাচক দিক হলো, ধারাবাহিকভাবে কৃষির শ্রমবাজারের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ঘটছে। সেই সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে কৃষিশ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত আছে। নব্য উদারনীতিবাদী অর্থনীতিতে কৃষিপণ্য রপ্তানির ধারা সৃষ্টি হওয়ায় এসব পরিবর্তন আসছে বলে তিনি মনে করেন।

সেমিনার সঞ্চালনা করেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন। স্বপন আদনানের কথার সূত্রে তিনি বলেন, দেশের প্রায় ৪৮ শতাংশ কৃষি জমি ইজারার অধীনে চলে গেছে আর এই ইজারার জমির প্রায় অর্ধেক চাষ করছেন ভূমিহীন চাষিরা। এ প্রসঙ্গ তুলে তিনি একটি গবেষণা প্রশ্ন উত্থাপন করেন। সেটা হলো, এই পরিবর্তনের ফলে উৎপাদনশীলতায় কী পরিবর্তন আসছে। এ ক্ষেত্রে তাঁর অবস্থান উন্মুক্ত, বলেন, হতে পারে ভূমিহীন চাষিরা নানা সীমাবদ্ধতার কারণে বড় ধরনের উৎপাদনে যেতে পারবেন না, তাঁরা হয়তো ধান ফলাবেন। আবার তাঁদের মধ্যে শিক্ষিত মানুষের আবির্ভাব ঘটলে বাণিজ্যিক কৃষির সম্ভাবনা তৈরি হবে। এ নিয়ে গবেষণা করেছেন বিনায়ক সেন।

বিনায়ক সেন জানান, এ বিষয়ে আরও বিশদ গবেষণা করার পরিকল্পনা বিআইডিএসের আছে। সম্ভব হলে এ বছরই তা শুরু হবে। এই পর্যায়ে স্বপন আদনান বিনায়ক সেনের কাছে জানতে চান, এই ভূমিহীন চাষিরা পরিচালন পুঁজি কোথা থেকে পাচ্ছেন। জবাবে বিনায়ক সেন বলেন, অকৃষি খাতের আয়, অভ্যন্তরীণ রেমিট্যান্স, ক্ষুদ্রঋণ-এসব উৎস থেকে পরিচালনা পুঁজি আসছে।

অনীহা নয়, অনিশ্চয়তা

বক্তৃতার একপর্যায়ে স্বপন আদনান বলেন, দেশের গ্রামাঞ্চলে কৃষিকাজের প্রতি একধরনের অনীহা তৈরি হয়েছে। অকৃষি খাতের বিকাশের কারণে এটা ঘটছে। তবে এ কথার সঙ্গে কৃষি অর্থনীতিবিদ এম এ সাত্তার মণ্ডল দ্বিমত পোষণ করেন। বলেন, দেশের মানুষ কৃষিকাজের প্রতি অনীহ, তা নয়; বরং কৃষি খাতে যেভাবে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হচ্ছে, তার কারণে মানুষ পিছপা হচ্ছেন। ধান উৎপাদন করে দাম পাওয়া যায় না, চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার কারণে চাষের ধরন বদলে যাওয়া-এসব কারণ মানুষকে কিছুটা কৃষিবিমুখ করে তুলছে। তিনি আরও বলেন, এ বছর তীব্র গরমের কারণে আমন ধান উৎপাদনেও সেচ দিতে হচ্ছে।

সম্পদের ঘনীভবন

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক মাহবুব উল্লাহ নোয়াখালীর গ্রামের অভিজ্ঞতার আলোকে স্বপন আদনানের বক্তৃতায় আলোকপাত করেন। বলেন, ১৯৮৬ সালে জরিপ করার সময় দেখেছি, গ্রামে যাঁদের অকৃষি আয় বেশি, তাঁদের কৃষি আয় কম। এরপর ১৯৯৮ সালে সেই গ্রামে দেখা গেল, যাঁদের অকৃষি আয় বেশি, তাঁদের কৃষি আয়ও বাড়ছে, তবে সেটা তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। আগে যাঁরা ভূমিহীন ছিলেন, তাঁদের অকৃষি আয়ের অনুপাত বেশি ছিল। এখন দেখা যাচ্ছে, যাঁদের অকৃষি আয় বেশি, তাঁদের কৃষি আয়ও বেশি।

অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, দেশে মানুষ বেড়েছে আবার কৃষি জমির পরিমাণ কমলেও উৎপাদন অনেক বেড়েছে। এসব সম্ভব হয়েছে কৃষির যন্ত্রীকরণের মাধ্যমে। এখন যে পরিবর্তন হচ্ছে, তাতেও ইতিবাচক ফল মিলবে বলে তাঁরা আশাবাদী।

অনুষ্ঠানে বিআইডিএসসহ দেশের বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার গবেষক ও সাংবাদিকেরা উপস্থিত ছিলেন।