২০২০ সালে বিশ্বের অধিকাংশ অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে। ২০২১ সাল থেকে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার শুরু হয়। অনেক দেশই সে বছর ঘুরে দাঁড়ায়। ধারণা করা হয়েছিল, ২০২২ সালে এই পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া অনেকটাই গতি পাবে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালালে বিশ্ব পরিস্থিতি নতুন মোড় নেয়। শুরু হয় নানা ধরনের সংকট, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ‘পলিক্রাইসিস’। ইতিহাসবিদ অ্যাডাম টুজ এই শব্দবন্ধটি জনপ্রিয় করে তোলেন। বাস্তবতা হলো, ২০২৩ সালে যুদ্ধজনিত সংকট অবসানের লক্ষণ তো নেই, বরং পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে।
আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সামষ্টিক অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক রোয়েল বিটসমা এএফপিকে বলেন, এই শতকের শুরু থেকেই সংকট বাড়তে শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে আর কখনো পরিস্থিতির এতটা অবনতি হয়নি।
২০২১ সালের মাঝামাঝি সময় বিশ্বের অধিকাংশ দেশ কোভিডজনিত বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করে নেয়। তখন হঠাৎ করেই মানুষের চাহিদা বেড়ে যায়। এত দিন নানা ধরনের বিধিনিষেধের কারণে মানুষ প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করেনি। অনিশ্চয়তার মধ্যে সেটাই স্বাভাবিক। হঠাৎ করে কেনাকাটা বেড়ে গেলে মূল্যস্ফীতি বাড়তে শুরু করে। সেই বাস্তবতায় বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলে, অর্থনীতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে, ফলে এই মূল্যস্ফীতি সাময়িক। কিন্তু সেই আশায় গুড়ে বালি। রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা শুরু করলে জ্বালানি ও খাদ্যের দাম আকাশ স্পর্শ করে। এরপর তো ইতিহাস-বিশ্বের দেশে দেশে রেকর্ড মূল্যস্ফীতি।
এই পরিস্থিতিতে অনেক দেশের মানুষ বিপাকে পড়েছে, কারণ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে একই হারে মজুরি বাড়েনি। এতে মানুষকে পারিবারিক ব্যয় কমাতে হয়েছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মূল দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। উচ্চ মূল্যস্ফীতির জমানায় তারাও বসে থাকেনি। ধাপে ধাপে নীতি সুদহার বাড়াতে থাকে তারা। এতে সমাজে অর্থপ্রবাহ কমে যায়। যাদের নিতান্ত প্রয়োজন আছে, কেবল তারাই ঋণ নেয় তখন। মানুষের হাতে ব্যয় করার মতো অর্থের টান পড়ে। চাহিদা কমে যায়।
নীতি সুদ বৃদ্ধির কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতির হার কমে এসেছে। কিন্তু পূর্বাভাস হচ্ছে, আগামী বছর এসব দেশ মন্দার কবলে পড়বে। অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) বলছে, জি-২০ ভুক্ত ও উদীয়মান দেশগুলোতে ২০২২ সালের শেষ প্রান্তিকে মূল্যস্ফীতির হার ৮ শতাংশে উঠবে, যদিও আগামী বছর তার গড় হার দাঁড়াবে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। এই বাস্তবতায় দেশে দেশে সরকারের প্রতি ওইসিডির আহ্বান, পারিবারিক সহায়তা দেওয়া হোক।
ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৭টি দেশ জনগণকে উচ্চ জ্বালানির হাত থেকে বাঁচাতে ৭০৪ বিলিয়ন বা ৭০ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বরাদ্দ করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দিয়েছে জার্মানি। তারা এযাবৎ ২৬৪ বিলিয়ন বা ২৬ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বরাদ্দ দিয়েছে। জার্মান নাগরিকেরা এক জরিপের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, তাঁরা এখন মূলত প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতেই অর্থ ব্যয় করছেন। এ ছাড়া নীতি সুদহার বৃদ্ধির কারণেও জার্মানির ভোক্তা ও ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
তবে মূল্যস্ফীতি ও নীতি সুদহার—উভয়ই চূড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছেছে। এই পরিস্থিতিতে নীতি সুদ বৃদ্ধির হার হ্রাস করেছে মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ ও ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে এখনই নীতি সুদহার হ্রাসের পক্ষে নয় তারা। এমনকি প্রয়োজনে তা আরও বাড়াতে হতে পারে বলে মনে করে তারা। তবে বৃদ্ধির হার কমে আসবে।
অর্থনীতিবিদেরা ধারণা করছেন, জার্মানি ও ইতালি মন্দার কবলে পড়বে। যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি ইতিমধ্যে সংকুচিত হতে শুরু করেছে। ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল মনে করছে, ইউরো অঞ্চল ২০২৩ সালে স্থবিরতার কবলে পড়বে।
তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এত কিছুর পরও মনে করছে, বিশ্ব অর্থনীতি ২০২৩ সালে সম্প্রসারিত হবে। প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়াবে ২ দশমিক ৭ শতাংশ, আর ওইসিডির পূর্বাভাস, প্রবৃদ্ধি হবে ২ দশমিক ২ শতাংশ।
গত নভেম্বর মাস পর্যন্ত চীন একভাবে শূন্য কোভিড নীতি অনুসরণ করেছে। সম্প্রতি শ্রমিক ও জন বিক্ষোভের মুখে তারা শূন্য কোভিড নীতি থেকে সরে আসার ঘোষণা দেয়। ফলে সেখানে চাহিদা বাড়বে। এ ছাড়া তারা ঘোষণা দিয়েছে, আগামী ৮ জানুয়ারি থেকে বিদেশ থেকে এলে আর নির্জন আবাসে থাকতে হবে না। ফলে চীন আরও উন্মুক্ত হচ্ছে।
রোয়েল বিটসমা মনে করেন, আগামী পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। এএফপির সংবাদে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২৬ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। আর পুনবিমা কোম্পানি সুইস রির তথ্যানুসারে, কেবল হারিকেন ইয়ানের কারণে ক্ষতি হয়েছে ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। পাকিস্তানের বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৩ হাজার কোটি ডলার।
এবারের কপ ২৭-এ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত দেশগুলোর সাহায্যার্থে তহবিল গঠনের অঙ্গীকার করেছে দেশগুলো। কিন্তু জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বন্ধ করার বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি। এই বাস্তবতায় ভবিষ্যৎ ভালো নয় বলেই মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
বিটসমার মতে, জলবায়ু পরিবর্তন এখন সবচেয়ে বড় সংকট, যা অনেকটা স্লো মোশনের মতো করে মানবসভ্যতার দিকে ধেয়ে আসছে।