বিশ্বকাপ উন্মাদনায় ৪৭ লাখ ফুটবল-বাণিজ্য

দেশে ফুটবল আমদানি গত বছরের চেয়ে ৭৩ শতাংশ বেড়েছে। একেকটি বল বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ২ হাজার টাকা দামে।

কাতার বিশ্বকাপে মেসি, নেইমার, রোনালদো, এমবাপ্পেরা যে বলে জাদু দেখাচ্ছেন, তা বাংলাদেশের দোকানে উঠতেও বেশি সময় লাগেনি। ফুটবল বিশ্বকাপ শুরুর আগেই ক্রীড়াপণ্যের দোকানগুলোয় ঝুলছে এই বল। তবে বেশ উজ্জ্বল রঙের এবং দেখতে একই রকম হলেও এসব বল কিন্তু আসল নয়, পুরো নকল। নকলভেদে এ রকম একেকটি ফুটবলের দাম ৮৫০ থেকে দুই হাজার টাকা। 

এবারের বিশ্বকাপের ম্যাচ বল ‘আল রিহলা’ সরবরাহ করেছে জার্মানিভিত্তিক ক্রীড়াপণ্য বেচাকেনার প্রতিষ্ঠান অ্যাডিডাস। আর এই বল তৈরি হয়েছে পাকিস্তানের শিয়ালকোটের ফরওয়ার্ড স্পোর্টসের কারখানায়। অ্যাডিডাস ম্যাচ বলের বাইরে বিক্রি করছে ‘প্রো বল’। এর একেকটির দাম ১৬৫ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় সাড়ে ১৭ হাজার টাকা। বাংলাদেশের বাজারে ৪২০ গ্রাম ওজনের নকল আল রিহলার বল বিক্রি হচ্ছে ৮৫০ থেকে ২ হাজার টাকায়। সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই বল আমদানি হয়েছে চীন থেকে। 

প্রত্যেক বিশ্বকাপের মৌসুমে বাংলাদেশে ফুটবলের ব্যবসা বাড়িয়ে দেয় আকর্ষণীয় নকশার বিশ্বকাপের ম্যাচ বল। সেই ধারাবাহিকতায় জ্বলজ্বলে রঙের আল রিহলা বলও এবার বাংলাদেশে ফুটবল-বাণিজ্য বাড়িয়েছে। ব্যবসায়ীদের আমদানির তথ্যেও সত্যতা পাওয়া যাচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যে দেখা যায়, এবার শিশু থেকে সব বয়সীদের খেলার উপযোগী ৪৭ লাখ ফুটবল আমদানি হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৪৮ লাখ ডলার। এর শুল্কায়িত মূল্য ৫১ কোটি টাকা। বল আমদানিতে শুল্ক–করসহ মোট খরচ হয়েছে ৬৯ কোটি টাকা। বার্ষিক হিসাবে ২০২১ সালের তুলনায় এবার আমদানি ৭৩ শতাংশ বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশের খুচরা বাজারে এ বছর প্রথমবারের মতো ফুটবল বেচাকেনা শতকোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। 

এখন জার্সি বিক্রি বেশি। সেই সঙ্গে ফুটবলও বিক্রি হচ্ছে। তবে বিশ্বকাপ শেষে শহরে-গ্রামে যখন পুরোদমে মাঠে গড়াবে ফুটবল, তখন বিক্রি বাড়বে।
মোহাম্মদ মোস্তফা ভূঁইয়া, কর্ণধার, গ্রিন স্পোর্টস, চট্টগ্রাম এম এ আজিজ স্টেডিয়াম 

গায়ে জার্সি, হাতে বল

গত বুধবার রাতে চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়াম মার্কেটে গিয়ে দেখা যায়, বিশ্বকাপ ফুটবলের দুই দল ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার জার্সি কেনার যেন ধুম পড়েছে। কেউ জার্সি গায়ে চাপিয়ে ফুটবলও কিনছেন। কেউ শুধু ফুটবল, আবার অনেকেই কেবল জার্সি কিনেই বাড়ি ফিরছেন। স্টেডিয়াম পাড়ার গ্রীন স্পোর্টসের কর্ণধার মোহাম্মদ মোস্তফা ভূঁইয়া বলেন, এখন জার্সি বিক্রি বেশি। সেই সঙ্গে ফুটবলও বিক্রি হচ্ছে। তবে বিশ্বকাপ শেষে শহরে–গ্রামে যখন পুরোদমে মাঠে গড়াবে ফুটবল, তখন বিক্রি বাড়বে।

জানতে চাইলে একই মার্কেটের পাইওনিয়ার স্পোর্টসের কর্ণধার খাজা মাঈনুদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার ফুটবলের দাম একটু বেশি। কারণ, ডলারের বিনিময় মূল্য বাড়ায় আমদানিতে খরচ পড়েছে বেশি। 

জানা গেছে, এ বছর ঢাকার রিগ্যাল স্পোর্টস ৬০ হাজার ফুটবল আমদানি করেছে। মাওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়ামের এই প্রতিষ্ঠানের কর্মী মো. সেলিম জানান, তাঁরা একেকটি ফুটবল ১৫০ থেকে আড়াই হাজার টাকা দামে বিক্রি করছেন। এবার বল ভালো বিক্রি হচ্ছে।

আরও পড়ুন

ব্র্যান্ডের ফুটবলের চাহিদাও বেশ 

ফ্রান্সভিত্তিক ক্রীড়াসামগ্রীর খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ডিক্যাথেলন ঢাকার উত্তরার নিজস্ব আউটলেটে নিজেদের ‘কিপস্টা’ ব্র্যান্ডের ফুটবল বিক্রি করছে। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে দেখা যায়, ফিফা বেসিক সিরিজের ফুটবল ১ হাজার ৯৯০ টাকায় ও রেগুলার সিরিজের ফুটবল ১ হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি করছে তারা। স্টোরটিতে শিশু থেকে সব বয়সের খেলার উপযোগী ফুটবল রয়েছে। দুই থেকে ১৮ বছর বয়সীদের খেলার উপযোগী রাবারের ফুটবল বিক্রি হচ্ছে ১৯৯ টাকায়। 

যোগাযোগ করলে ডিক্যাথেলনের রিটেইল লিডার সিফাত রহমান প্রথম আলোকে বলেন, করোনার দুই বছরে ফুটবল সেভাবে মাঠে গড়ায়নি। এবার বিশ্বকাপ ফুটবলের উন্মাদনা ছাড়াও আন্তবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতা এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ফুটবল টুর্নামেন্ট বেড়েছে। ফলে আগের দুই বছরের তুলনায় ফুটবল বিক্রি এবার বেশি।

জার্মানভিত্তিক পুমা ব্র্যান্ড ঢাকার ধানমন্ডি, বসুন্ধরা ও বনানীর তিনটি আউটলেটে ফুটবল বিক্রি করছে। তাদের এসব আউটলেটে স্পোর্টসওয়্যারের পাশাপাশি পুমা ব্র্যান্ডের ফুটবলও বিক্রি হচ্ছে। প্রতিটি ফুটবলের দাম ২ হাজার ১৯৯ টাকা থেকে ২ হাজার ৬৯৯ টাকা। বাংলাদেশে পুমার অনুমোদিত ফ্র্যাঞ্চাইজি পার্টনার ডিবিএল গ্রুপ। জানতে চাইলে ডিবিএল গ্রুপের সিনিয়র ম্যানেজার (ব্র্যান্ড অ্যান্ড কমিউনিকেশন) রেজওয়ান হাবিব বলেন, ‘বিশ্বকাপ মৌসুমে ফুটবল বিক্রিতে আমরা ভালো সাড়া পেয়েছি। ইতিমধ্যে আমাদের ফুটবলের স্টক শেষ। নতুন করে আরও ফুটবল আনার ব্যবস্থা করেছি।’

মাঠে পিছিয়ে, আমদানিতে এগিয়ে

ফিফা র‍্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ একেবারে তলানিতে রয়েছে। ২০১৯ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৮৪তম। এরপর কেবল পিছিয়েছে। বর্তমান অবস্থান ১৯২তম। র‍্যাঙ্কিংয়ে তলানিতে থাকলেও ফুটবল আমদানিতে কিন্তু বাংলাদেশ পিছিয়ে নেই। 

বাজার গবেষণা সংস্থাগুলোর হিসাবে, বিশ্বে ফুটবল আমদানিতে ২০২০ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৫৪তম। এ তালিকায় শীর্ষ পাঁচটি স্থানে রয়েছে যথাক্রমে জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস ও যুক্তরাষ্ট্র। পাঁচ দেশই এবারকার বিশ্বকাপ ফুটবলে খেলছে।  

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় মূলত রাবারের ফুটবল। চলতি বছর আমদানি হওয়া ৪৭ লাখ ফুটবলের মধ্যে ৩২ লাখের বেশিই রাবারের ফুটবল। কৃত্রিম তন্তু ও অন্যান্য উপকরণ দিয়ে বানানো ফুটবল আমদানি হয় ১৫ লাখ। 

আরও পড়ুন

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের শীর্ষে চীন 

ফুটবলের মাঠ কাঁপাতে না পারলেও বাণিজ্যের মাঠ কাঁপাতে জুড়ি নেই চীনের। এবারের বিশ্বকাপে নেই দেশটি। তবে বিশ্বে ফুটবল-বাণিজ্যে সব সময় এক নম্বরেই থাকে দেশটি। ২০২০ সালে ৪৬ কোটি ডলারের ফুটবল রপ্তানি করেছে তারা। বাংলাদেশেও সবচেয়ে বেশি ফুটবল রপ্তানি করে দেশটি। শুধু কি তাই? এ দেশে যত ফুটবল আমদানি হয়, তার ৯৫ শতাংশই আসে চীন থেকে।

বাজার গবেষণাকারী সংস্থা আইমার্কের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে বিশ্বে ফুটবলের বাজার ছিল ৩০২ কোটি ডলারের, যা বাংলাদেশের প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকার সমান (প্রতি ডলার ১০৬ টাকা ধরে)। আগামী ২০২৭ সালে এই বাজারের আকার বেড়ে ৩৮৭ কোটি ডলারে দাঁড়াতে পারে বলে প্রতিবেদনটিতে অনুমান করা হয়। 

এ বাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছে ক্রীড়াসামগ্রী প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান অ্যাডিডাস, পুমা, নাইকি, ডিক্যাথেলন, ফ্রাঙ্কলিন, ফরমেটিভ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান। তারা বিভিন্ন দেশ থেকে ফুটবল বানিয়ে নিচ্ছে। সে তালিকায় চীনের পরে আছে পাকিস্তান, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও জার্মানি।

আরও পড়ুন

নির্ভার বাণিজ্য ফুটবলে

বিশ্বকাপে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি সমর্থক ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার। এ দুই দলের জার্সিও বিক্রি হচ্ছে বেশি। ম্যাচসংখ্যা যত এগেচ্ছে, তত ভয়ও ভর করছে বিক্রেতাদের মনে। কারণ, দুই দলের কোনো একটি দল ছিটকে গেলে জার্সি বেচাকেনায় ধস নামবে। জার্সির মতো ফুটবল বিক্রি নিয়ে তেমন ভয় নেই বলে জানান ব্যবসায়ীরা।

ফুটবল বিক্রি নিয়ে ভয় না পাওয়ার ব্যাখ্যাও দেন বিক্রেতারা। তাঁরা জানান, ফুটবল বিক্রির মৌসুম মাত্র শুরু হয়েছে। প্রতি জেলায় ফুটবল লিগের মৌসুম চলছে। সেই সঙ্গে চলছে বিক্রিও। আবার গ্রামাঞ্চলে আমন ধান কাটা শেষের দিকে। ধান কাটা শেষে খেত ফাঁকা হতে না হতেই গ্রামে-গঞ্জে ব্যাপক হারে মাঠে গড়াবে ফুটবল। খেত–মাঠ–স্টেডিয়ামে পুরোদমে ফুটবল খেলা শুরু হলে বেচাকেনাও বাড়বে বলে আশা বিক্রেতাদের।