রিটার্ন জমায় যা কিছু জানতে ও জানাতে হবে
রিটার্ন জমার মৌসুম ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। সে জন্য এখন থেকেই আপনাকে প্রস্তুতি নিতে হবে। কারণ, নতুন আয়কর আইনে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। পুরোনো ফরমে এবার রিটার্ন জমা দেওয়া যাবে না। আইনের নতুন ধারা অনুযায়ী রিটার্ন সাজাতে হবে।
নতুন আয়কর আইনে আপনাকে বার্ষিক আয়-ব্যয়ের খবর জানিয়ে তবেই রিটার্ন জমা দিতে হবে। রিটার্ন জমার মৌসুম ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। সে জন্য এখন থেকেই আপনাকে প্রস্তুতি নিতে হবে। কারণ, পুরোনো ফরমে আর রিটার্ন জমা দেওয়া যাবে না। আইনের নতুন ধারা অনুযায়ী রিটার্ন সাজাতে হবে। এটি বুঝতে আপনার কিছু সময় লেগেও যেতে পারে।
নতুন আইনের আলোকে আপনি কীভাবে রিটার্ন তৈরি করবেন, সেটিই এখানে তুলে ধরা হয়েছে। চলুন দেখা যাক কোথায় কী পরিবর্তন ঘটল। প্রথমেই বলা যায়, করমুক্ত আয়ের ও সারচার্জের সীমা বেড়েছে। যা-ই হোক, আবার এক পাতার রিটার্ন ফরম তৈরি হয়েছে।
বর্তমানে দেশে প্রায় ৯০ লাখ টিআইএনধারী আছেন। তাঁদের মধ্যে প্রতিবছর ৩০ লাখের মতো লোক নিজেদের আয়-ব্যয়ের বিস্তারিত জানিয়ে রিটার্ন জমা দেন। রিটার্ন জমার সময় হলো ১ জুলাই থেকে ৩০ নভেম্বর।
নতুন আইন অনুযায়ী, জীবনযাত্রার বিবরণীতে ৯ ধরনের তথ্য দিতে হবে। এগুলো হচ্ছে ব্যক্তিগত ও পরিবারের ভরণপোষণের ব্যয়, আবাসনসংক্রান্ত খরচ, গাড়ির ব্যয়, পরিষেবা খরচ, শিক্ষা ব্যয়, নিজ খরচে দেশ-বিদেশ ভ্রমণ ও অবকাশসংক্রান্ত তথ্য, উৎসবের খরচ, সঞ্চয়পত্রসহ অন্যান্য উৎসে করের হিসাব এবং প্রাতিষ্ঠানিক ও অন্যান্য উৎস থেকে নেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধের তথ্য।
করমুক্ত আয়সীমা বৃদ্ধি
ব্যক্তিশ্রেণির করদাতারা তিন-চার মাস আগেই চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বার্ষিক করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৩ লাখ টাকা করার সুখবর পেয়েছেন। সেই সঙ্গে নারী করদাতা ও ৬৫ বছরের বেশি বয়সী করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা ৪ লাখ টাকা করা হয়েছে, যা তৃতীয় লিঙ্গের করদাতা ও প্রতিবন্ধী করদাতাদের জন্য ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা এবং গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা করদাতাদের ক্ষেত্রে ৫ লাখ টাকা করা হয়।
আপনার আয় করমুক্ত সীমা অতিক্রম করলেই ন্যূনতম কর দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি এবং চট্টগ্রাম সিটির করদাতাদের ৫ হাজার টাকা; অন্যান্য সিটির করদাতাদের ৪ হাজার টাকা এবং বিভিন্ন এলাকার করদাতাদের ন্যূনতম ৩ হাজার টাকা কর দিতেই হবে।
এবারের বাজেটে সারচার্জে ধনীদের ছাড় দেওয়া হয়েছে। এত দিন তিন কোটি টাকার বেশি সম্পদ থাকলেই সারচার্জ দেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। এবারের বাজেটে এই সীমা বাড়িয়ে চার কোটি টাকা করা হয়েছে।
যাঁদের রিটার্ন দেওয়া বাধ্যতামূলক
দেশে সব মিলিয়ে ৪৩টি সরকারি-বেসরকারি সেবা নিতে আগের মতো রিটার্ন জমার রসিদ লাগবে। গত বছর পর্যন্ত ৩৮টি সেবা পেতে রিটার্ন জমার রসিদ লাগত। নতুন আয়কর আইনে পাঁচটি সেবা যোগ করা হয়েছে। সেবাগুলো হচ্ছে নির্দিষ্ট ব্যক্তি কর্তৃক সিটি করপোরেশন এলাকায় বাড়িভাড়া বা লিজ গ্রহণ (বাড়ির মালিক); নির্দিষ্ট ব্যক্তি কর্তৃক সেবা বা পণ্য গ্রহণ (সরবরাহকারী); ট্রাস্ট, তহবিল, ফাউন্ডেশন, এনজিও, ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী সংস্থা, সোসাইটি ও সমবায় সমিতির ব্যাংক হিসাব খোলা ও চালু রাখা; স্ট্যাম্প, কোর্ট ফি ও কার্টিজ পেপারে ভেন্ডর বা দলিল লেখক হিসেবে নিবন্ধন, লাইসেন্স বা তালিকাভুক্ত করা বা বহাল রাখা; রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা সরকার কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে গঠিত এমন কর্তৃপক্ষ বা অন্যান্য সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় অনুমোদনের জন্য ভবন নকশার আবেদন দাখিল।
আগে থেকেই রিটার্ন জমার রসিদ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ২০ লাখ টাকার বেশি ঋণের জন্য আবেদন করলে; ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনলে; গাড়ি থাকলে, ক্রেডিট কার্ড নিলে; সরকার থেকে ১৬ হাজার টাকার বেশি বেতন পেলে; কোনো কোম্পানির পরিচালক বা শেয়ারহোল্ডার হলে; ব্যবসায়ী সমিতির সদস্য হলে; কারও সন্তান বা পোষ্য ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াশোনা করলে; অস্ত্রের লাইসেন্স নিলে; উপজেলা, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন ও জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হলে।
৫ লাখ টাকার কম আয়ে এক পাতার রিটার্ন
বার্ষিক করযোগ্য আয় পাঁচ লাখ টাকার কম হলে ও সম্পদের পরিমাণ ৪০ লাখ টাকার নিচে থাকলে এবার এক পাতার আয়কর বিবরণী জমা দিলেই হবে। এ ধরনের করদাতার জন্য এক পাতার একটি ফরম প্রকাশ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
এক পাতার ওই ফরমে সব মিলিয়ে ১৬ ধরনের তথ্য দিতে হবে। এগুলো হচ্ছে নাম, জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) নম্বর, কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন), সার্কেল, কর অঞ্চল, করবর্ষ, আবাসিক মর্যাদা, মোবাইল নম্বরসহ যোগাযোগের ঠিকানা, আয়ের উৎস, মোট পরিসম্পদ, মোট আয়, আরোপযোগ্য কর, কর রেয়াত, প্রদেয় কর, উৎসে কাটা করের পরিমাণ (যদি থাকে), এই রিটার্নের সঙ্গে প্রদত্ত কর, জীবনযাপন ব্যয়।
যেসব কাগজ জমা দিতে হবে
আয়কর বিবরণী দাখিলের সময় প্রমাণ হিসেবে কিছু কাগজপত্র জমা দিতে হয়। এখন সেসব কাগজপত্র জোগাড় করতে হবে। এগুলোর অন্যতম হলো বেতন খাতের আয়ের দলিল, সিকিউরিটিজের ওপর সুদ আয়ের সনদ, ভাড়ার চুক্তিপত্র, পৌরকরের রসিদ, বন্ধকি ঋণের সুদের সনদ, মূলধনি সম্পদের বিক্রয় কিংবা ক্রয়মূল্যের চুক্তিপত্র ও রসিদ, মূলধনি ব্যয়ের আনুষঙ্গিক প্রমাণপত্র, শেয়ারের লভ্যাংশ পাওয়ার ডিভিডেন্ড ওয়ারেন্ট, সুদের ওপর উৎসে কর কাটার সার্টিফিকেট।
কর রেয়াত নিতে চাইলে বেশ কিছু কাগজপত্র লাগবে। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো জীবনবিমার কিস্তির প্রিমিয়াম রসিদ, ভবিষ্য তহবিলে চাঁদার সনদ, ঋণ বা ডিবেঞ্চার, সঞ্চয়পত্র, শেয়ারে বিনিয়োগের প্রমাণপত্র, ডিপোজিট পেনশন স্কিমের (ডিপিএস) চাঁদার সনদ, কল্যাণ তহবিলের চাঁদা ও গোষ্ঠী বিমার কিস্তির সনদ, জাকাত তহবিলে দেওয়া চাঁদার সনদ।
২২ খাতের আয়ে কর অব্যাহতি
একজন করদাতাকে তাঁর সব ধরনের আয়ের ওপর কর দিতে হয় না। কোনো কোনো আয় পুরোপুরি করমুক্ত; আবার কোনো আয়ে নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত কর অব্যাহতি সুবিধা মেলে। নতুন আয়কর আইনে এমন ২২টি খাত চিহ্নিত করা হয়েছে।
এই খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে সরকারি পেনশন তহবিল থেকে করদাতার গৃহীত বা বকেয়া পেনশন; সরকারি আনুতোষিক তহবিল থেকে করদাতার প্রাপ্ত ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত; পেনশনার সেভিংস সার্টিফিকেট থেকে সুদ হিসেবে গৃহীত কোনো অর্থ বা গৃহীত অর্থের সমষ্টি, যে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আয় করবর্ষের শেষে উক্ত সার্টিফিকেটের বিনিয়োগ করা অর্থের মোট পুঞ্জীভূত অর্জিত মূল্য/প্রকৃত মূল্য/আক্ষরিক মূল্য/ক্রয়মূল্য (অনধিক ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত); বিদেশে উপার্জিত কোনো আয়; কোনো করদাতা কর্তৃক ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট ফান্ড, ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড, ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড, ইউরো প্রিমিয়াম বন্ড, ইউরো ইনভেস্টমেন্ট বন্ড, পাউন্ড স্টার্লিং ইনভেস্টমেন্ট বন্ড বা পাউন্ড স্টার্লিং প্রিমিয়াম বন্ড থেকে গৃহীত আয়; শর্ত সাপেক্ষে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ‘কৃষি থেকে আয়’; পুরস্কারের অর্থ; তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ২৭ ধরনের আয়।
মোবাইল রিচার্জের খবর জানাতে হবে
বার্ষিক পাঁচ লাখ টাকার বেশি আয় এবং ৪০ লাখ টাকার বেশি সম্পদ থাকলেই সম্পদের বিবরণীসহ জীবনযাত্রার বিবরণী জমা দিতেই হবে।
জীবনযাত্রার খরচের বিবরণীতে এবার মোবাইল ফোনের রিচার্জ, ইন্টারনেট প্যাকেজের তথ্যও দিতে হবে। নতুন আয়কর আইন অনুযায়ী, রিটার্ন জমার সময় জীবনযাত্রার খরচের বিবরণী দাখিলের সব তথ্য দিতে হবে। এ ছাড়া গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ বিলের তথ্যও দিতে হবে। আইটি ১১গ (২০২৩) ফরমে জীবনযাত্রার ব্যয়-সম্পর্কিত বিষয়াবলি দিতে হয়।
নতুন আইন অনুযায়ী, জীবনযাত্রার বিবরণীতে ৯ ধরনের তথ্য দিতে হবে। এগুলো হচ্ছে ব্যক্তিগত ও পরিবারের ভরণপোষণের ব্যয়, আবাসনসংক্রান্ত খরচ, গাড়ির ব্যয়, পরিষেবা খরচ, শিক্ষা ব্যয়, নিজ খরচে দেশ-বিদেশ ভ্রমণ ও অবকাশসংক্রান্ত তথ্য, উৎসবের খরচ, সঞ্চয়পত্রসহ অন্যান্য উৎসে করের হিসাব এবং প্রাতিষ্ঠানিক ও অন্যান্য উৎস থেকে নেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধের তথ্য।