মূল্যস্ফীতিই ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি মূল হুমকি, জরিপে বলেছেন দেশের সিইওরা

পিডব্লিউসির লোগোছবি: সংগৃহীত

মূল্যস্ফীতির উচ্চ হারকে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মূল হুমকি বলে মনে করেন বিভিন্ন কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা। সেই সঙ্গে সামষ্টিক অর্থনীতিতে যে দুই বছর ধরে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে, সেটাকেও ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন প্রধান নির্বাহীরা।

প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপারসের এক জরিপে অংশ নেওয়া দেশের বিভিন্ন কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা (সিইও) ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির জন্য মূল হুমকি হিসেবে যেসব বিষয় চিহ্নিত করেছেন, তার মধ্যে প্রধান দুটি হুমকি হিসেবে তাঁরা মূল্যস্ফীতি ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার কথা বলেছেন। আগের বছরও প্রধান তিনটি হুমকির মধ্যে এই দুটি বিষয় ছিল।

তবে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, মূল্যস্ফীতি উদ্বেগের কারণ হতে পারে না।

জরিপে অংশ নেওয়া প্রায় অর্ধেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা ৪৭ শতাংশ সিইও মূল্যস্ফীতিকে মূল হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, গত বছরের জরিপেও ৪৭ শতাংশ সিইও মূল্যস্ফীতিকে ব্যবসার মূল হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।

গত বছরের মার্চ থেকে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের ওপরে। এই পরিস্থিতিতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে বলে অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমলে বেচাকেনা কমে যায়; স্বাভাবিকভাবে বিষয়টি তখন ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে যায়।

মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষ বিপর্যস্ত হলেও অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী অবশ্য তা নিয়ে চিন্তিত নন। তিনি বলেছেন, মূল্যস্ফীতি দেশের মানুষের মূল উদ্বেগের কারণ হতে পারে না। দেশে এক কোটি পরিবার কার্ড দেওয়া হয়েছে, সে জন্য তিনি মনে করেন, মূল্যস্ফীতি উদ্বেগের বিষয় হতে পারে না। সম্প্রতি জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গে অনুষ্ঠিত অধিবেশন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন তিনি।

২০২২ সাল থেকেই দেশে সামষ্টিক অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। গত বছরের সিইও জরিপেও এ বিষয়টি উঠে আসে। তবে চলতি বছর ৪৫ শতাংশ সিইও এটিকে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছেন; গত বছর এই হার ছিল ৩৪ শতাংশ।
তৃতীয় হুমকি হিসেবে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার বিষয়টি উঠে এসেছে এবং এ ক্ষেত্রে উদ্বিগ্ন সিইওদের হার বেড়েছে। ২০২৪ সালে যেখানে ২৯ শতাংশ প্রধান নির্বাহী ভূরাজনৈতিক উত্তেজনাকে ব্যবসা-বাণিজ্যের হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, ২০২৩ সালে সেখানে ২২ শতাংশ প্রধান নির্বাহী এ কথা বলেছিলেন। অর্থাৎ প্রধান নির্বাহীদের মানসিকতায় এ ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে বলে দেখা যাচ্ছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দুই বছর অতিক্রান্ত হলেও সংকট নিরসনের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে হামাস-ইসরায়েলের সংকট তীব্র আকার ধারণ করছে। হামাসের সমর্থনে অন্যান্য দেশ ও বাহিনীর জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বাড়ছে। লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা চালাচ্ছে হুতি বিদ্রোহীরা। সর্বোপরি ইউক্রেন সংকটে ইউরোপ বেকায়দায় পড়েছে এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে ইউরোপের ভূরাজনীতি বদলে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রপ্তানিতে প্রভাব পড়ার আশঙ্কা আছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় গন্তব্য হচ্ছে ইউরোপ।

এ ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য আরও যেসব হুমকি প্রধান নির্বাহীরা চিহ্নিত করেছেন, সেগুলো হলো সামাজিক অসমতা, সাইবার ঝুঁকি, জলবায়ু পরিবর্তন ও স্বাস্থ্যের ঝুঁকি।
জরিপে অংশ নেওয়া ১৭ শতাংশ সিইও সামাজিক অসমতাকে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন; গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে যা ছিল ১৬ শতাংশ। এবার জলবায়ু পরিবর্তনকে ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ১৪ শতাংশ প্রধান নির্বাহী; আগের বছর যা ছিল ১৩ শতাংশ। এ ছাড়া স্বাস্থ্যের ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ১৪ শতাংশ প্রধান নির্বাহী; আগের বছর যা ছিল ১৬ শতাংশ।

এ ছাড়া প্রধান নির্বাহীরা বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন মূল্যস্ফীতি, সামষ্টিক অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সাইবার ঝুঁকি, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, জলবায়ু পরিবর্তন, স্বাস্থ্যের ঝুঁকি ও সামাজিক অসমতা।

জরিপের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রযুক্তিগত ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বৈশ্বিক প্রবণতার প্রভাব বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে পড়ছে। সে জন্য দেশের বাজারব্যবস্থা প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে।

জরিপে অংশ নেওয়া ৯৫ শতাংশ প্রধান নির্বাহী বলেছেন, গত পাঁচ বছরে তাঁরা কোনো না কোনো পরিবর্তন এনেছেন। শুধু তা–ই নয়, ৭২ শতাংশ বলেছেন যে গত পাঁচ বছরে তাঁরা অন্তত এমন একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যার বদৌলতে কোম্পানির ব্যবসায়িক মডেলে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে।

পরিবর্তন সত্ত্বেও উদ্বেগের বিষয় হলো, আগামী এক দশক বা তারপর ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থায়ীত্ব নিয়ে আশাবাদ কমছে। সেটা যেমন স্থানীয় পরিসরে, তেমনি বৈশ্বিক পরিসরেও। জরিপে অংশ নেওয়া ৫৭ শতাংশ বাংলাদেশি সিইও মনে করেন না, এখন তাঁরা যে মডেলে ব্যবসা করছেন, আগামী এক দশক বা ১০ বছর পর তা বিশেষ সহায়তা ছাড়া টিকে থাকতে পারবে। এর আগের বছর এই হার ছিল ৫০ শতাংশ।

গত বছরের ২ অক্টোবর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত বিশ্বের ১০৫টি দেশ ও অঞ্চলের ৪ হাজার ৭০২ জন সিইওকে নিয়ে এই জরিপ করা হয়। পিডব্লিউসি জানিয়েছে, বৈশ্বিক জরিপের অংশ হিসেবে বাংলাদেশেও এই জরিপ করা হয়। এতে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৫২ জন সিইও মতামত দেন। সিইওদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে জরিপটি করা হয়েছে।