দ্রুত ও সাহসী অর্থনৈতিক সংস্কার প্রয়োজন, বলেছেন বিশ্বব্যাংকের এ দেশীয় প্রধান

আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের (অ্যামচেম) মাসিক মধ্যাহ্ন ভোজসভায় বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদুল্লায়ে সেক এ কথা বলেন।

আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের (অ্যামচেম) মাসিক মধ্যাহ্ন ভোজসভায় বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদুল্লায়ে সেক (বাঁ থেকে দ্বিতীয়) বক্তব্য দেন। গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে
ছবি: অ্যামচেমের সৌজন্যে

বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর বা এ দেশীয় প্রধান আবদুল্লায়ে সেক বলেছেন, অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এবং দারিদ্র্য বিমোচনে প্রবৃদ্ধির শক্তিশালী ধারা বজায় রাখতে বাংলাদেশের দ্রুত ও সাহসী অর্থনৈতিক সংস্কার প্রয়োজন।

গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর একটি হোটেলে আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের (অ্যামচেম) মাসিক মধ্যাহ্ন ভোজসভায় বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদুল্লায়ে সেক এ কথা বলেন। ‘বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি: বিশ্বব্যাংকের সম্পৃক্ততা’ শীর্ষক এ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অ্যামচেমের সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ।

আবদুল্লায়ে সেক বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, এক বছর ধরে অর্থনীতিতে নানা চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আর্থিক লেনদেনের ভারসাম্যে চাপ পড়েছে, যা রিজার্ভ কমিয়েছে। অন্যদিকে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও টাকার অবমূল্যায়নের কারণে উচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। একই সময়ে একাধিক বিনিময় হার, সুদের হারের সীমা ঠিক করে দেওয়া, ব্যাংক খাতে অপর্যাপ্ত তদারকি অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলেছে।

মানুষের আয় বৃদ্ধির চেয়ে খাবারের দাম বেশি বেড়েছে, যা এ দেশের বহু পরিবারের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে।
আবদুল্লায়ে সেক, কান্ট্রি ডিরেক্টর বিশ্বব্যাংক, ঢাকা কার্যালয়

বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর বলেন, মানুষের আয় বৃদ্ধির চেয়ে খাবারের দাম বেশি বেড়েছে, যা এ দেশের বহু পরিবারের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়েছে। নানা অনিশ্চয়তায় বেসরকারি বিনিয়োগে প্রবৃদ্ধির গতি কমেছে। অবশ্য নির্বাচনের বছরে এমন চিত্র অস্বাভাবিক নয়। এ ছাড়া জ্বালানির উচ্চমূল্য, কাঁচামালের বাড়তি দাম এবং গ্যাস–বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের অভাবে শিল্পোৎপাদন কমেছে।

অর্থনীতির এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় কিছু স্বল্প মেয়াদি সংস্কার লাগবে বলে মনে করেন আবদুল্লায়ে সেক। এ জন্য তিনি কিছু উদাহরণ দেন। যেমন নমনীয় বিনিময় হার প্রবাসী শ্রমিকদের বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোয় সহায়তা করবে, আবার প্রবাসী আয়ও বাড়বে। এ ছাড়া সুদহারের সীমা তুলে দেওয়া ও মুদ্রানীতি শক্তিশালী করার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। একই সময়ে ঝুঁকিপূর্ণ আর্থিক খাতের সংস্কারে ব্যাংক খাতে শক্তিশালী তদারকি প্রয়োজন। সম্প্রতি মুদ্রানীতিতে কিছু সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এখন বাস্তবায়নের গতি দ্রুত করা প্রয়োজন।

আবদুল্লায়ে সেক বাংলাদেশকে তিনটি দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের পরামর্শ দেন। প্রথমত, বাংলাদেশের রপ্তানি খাত একক পণ্যের ওপর বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল। তাই স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে উত্তরণের পর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে রপ্তানি খাতে বৈচিত্র্য আনতে হবে। কারণ, রপ্তানি ও প্রবৃদ্ধির নতুন নতুন চালিকা শক্তি লাগবে। দ্বিতীয়ত, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রবৃদ্ধি অর্জনে কার্যকর বিনিয়োগ আনতে হবে। এ জন্য আর্থিক খাতের সংস্কার করতে হবে। ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। শেয়ারবাজারকে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের উৎস হিসেবে পরিণত করা উচিত। তৃতীয়ত, যানজট ও পরিবেশের দুর্বল পরিস্থিতির কারণে নগরায়ণের সুবিধা নেওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া অবকাঠামো দুর্বলতা ও মানবসম্পদ নিম্নমানের কারণে প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

এ ছাড়া শোভন কর্মসংস্থান তৈরি, লিঙ্গবৈষম্য কমানো, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা এসব বিষয়ে আরও বেশি উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দেন আবদুল্লায়ে সেক। তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন চাপে পড়লেও আমি বেশ আশাবাদী। কারণ, এ দেশের অর্থনীতির মৌলিক ভিত্তি বেশ শক্তিশালী। যেমন জনসংখ্যা বোনাস, তৈরি পোশাকের রপ্তানি বৃদ্ধি, বিশাল প্রবাসী গোষ্ঠী ইত্যাদি। সময়মতো সঠিক নীতি সংস্কার করতে পারলে আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি অর্জন না হওয়ার কোনো কারণ নেই।’

অ্যামচেমের সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বলেন, ‘কোভিডের মধ্যেও আমরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে ভালো করেছি। সারা বিশ্বেই এখন অনিশ্চয়তা রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও চ্যালেঞ্জ আছে। ব্যাংক খাত ঝুঁকিতে থাকলে পুরো আর্থিক খাত ঝুঁকিতে পড়ে। এই খাতে সুশাসন নিশ্চিত করা উচিত।

অনুষ্ঠানে সমাপনী বক্তব্য দেন অ্যামচেমের সহসভাপতি ও মাস্টারকার্ডের কান্ট্রি ম্যানেজার সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ফারুক সোবহান, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, ওরাকল বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজিং ডিরেক্টর রুবাবা দৌলা প্রমুখ।