বাজেটে অগ্রিম কর প্রত্যাহার চান ব্যবসায়ীরা

আগামী অর্থবছরের বাজেট সামনে রেখে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পরামর্শক কমিটির ৪৪তম সভায় অতিথিরা। গতকাল ঢাকার সোনারগাঁ হোটেলেছবি: প্রথম আলো

দেশের বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী নেতারা ব্যবসার খরচ কমাতে বিনিয়োগবান্ধব বাজেট চেয়েছেন। তাঁরা অগ্রিম কর প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। তা না হলে তাঁরা অগ্রিম দেওয়া কর ফেরত বা সমন্বয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। এ ছাড়া ব্যবসায়ী নেতারা অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য কর ন্যায়পাল নিয়োগ ও ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রস্থান নীতিমালা করার তাগিদ দিয়েছেন।

আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট সামনে রেখে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পরামর্শক কমিটির ৪৪তম সভায় এসব প্রস্তাব দেন ব্যবসায়ী নেতারা। তাঁদের অধিকাংশই বলেছেন যে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও ডলার–সংকট এবং ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহারের কারণে দেশে ব্যবসার খরচ বেড়ে গেছে। এতে ব্যবসায়ীরা চাপে রয়েছেন।

রাজধানীর একটি হোটেলে গতকাল বৃহস্পতিবার এনবিআর এবং বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) যৌথভাবে এই সভার আয়োজন করে। সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এতে সভাপতিত্ব করেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলম।

সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী
ছবি: প্রথম আলো

অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী সভায় ব্যবসায়ীদের উপস্থাপিত কোনো দাবি নিয়েই কোনো কথা বলেননি। বাজেটের দর্শন নিয়েও তেমন কিছু বলেননি তিনি। অন্য যেকোনো অনুষ্ঠান শেষে অর্থমন্ত্রী সাধারণত যা বলে থাকেন, সে রকমই বলেছেন। আর সেটি হচ্ছে, ‘দেখা যাক কী করি, কতটুকু করতে পারি।’

অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান রপ্তানি বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, ‘এটি বাড়াতে হবে। নইলে ডলার আসবে কোথা থেকে?’ তিনি কর ন্যায়পাল নিয়োগের বিষয়টি ভেবে দেখবেন বলে উল্লেখ করেন।

প্রায় আড়াই ঘণ্টার এই অনুষ্ঠানে ৪০ মিনিটের মতো কথা বলেন আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ও শুল্ক—এনবিআরের এই তিন বিভাগের তিন সদস্য। করব্যবস্থা ব্যবসাবান্ধব করার স্বার্থে এনবিআর গত বছর যেসব নীতি পদক্ষেপ নিয়েছে, তাঁরা পাওয়ার পয়েন্টের মাধ্যমে সেগুলো তুলে ধরেন। পরে এর পক্ষে যুক্তি দিয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, ‘অনেকেই বলেন যে আমরা কিছু করি না। আমরা যে কিছু করি, তা দেখানোর জন্যই এ আয়োজন।’

বক্তব্য দিচ্ছেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম (বাঁ থেকে দ্বিতীয়)
ছবি: প্রথম আলো

এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের স্থায়ী পরিকাঠামো উন্নয়নে স্বচ্ছতা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। কর আদায়ের ক্ষেত্রে হয়রানি ও জটিলতা দূর করা প্রয়োজন। এ ছাড়া ব্যবসাবান্ধব কর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে আগামী বাজেটে বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার। তিনি আয়কর, ভ্যাট ও কাস্টমস প্রশাসনকে সমন্বয় ও অটোমেশনের আওতায় আনার পাশাপাশি রাজস্ব কর্মকর্তাদের পুরস্কারের বদলে বিকল্পভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার পরামর্শ দেন।

এফবিসিসিআই সভাপতি ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা সাধারণভাবে সাড়ে চার লাখ টাকা এবং জ্যেষ্ঠ নাগরিক ও নারীদের জন্য তা পাঁচ লাখ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছেন। মূল্যস্ফীতি ও স্বল্প আয়ের মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাওয়ার বিষয় বিবেচনা করে এই প্রস্তাব দেন তিনি।

মুক্ত আলোচনায় বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেন বস্ত্রকলমালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী
ছবি: প্রথম আলো

বাজেটে যা চান ব্যবসায়ীরা
পরামর্শক সভায় বিভিন্ন বাণিজ্য সংগঠন ও চেম্বারের ব্যবসায়ী নেতারা কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন মাত্র ১ ঘণ্টা। এই সময়ের মধ্যেই অন্তত ২৫ জন ব্যবসায়ী বর্তমান ব্যবসায়িক সংকটের পাশাপাশি বাজেটে পাসের জন্য বিভিন্ন দাবিদাওয়া তুলে ধরেন।

বস্ত্রকলমালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা ভালো নেই। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও ডলার–সংকটের পাশাপাশি রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) সংকুচিত করা হয়েছে। দিন শেষে কিছু আমদানি করতে গেলেই তো ডলারের প্রয়োজন হয়। তবে ডলার আমদানির সঙ্গে যুক্ত শিল্পমালিকেরা কীভাবে এত এত প্রতিবন্ধকতা ও আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবেন! ব্যাংক লুণ্ঠনকারীদের বিচার করুন আর সত্যিকারের ব্যবসায়ীদের ব্যবসা যদি বন্ধ হয়, তাহলে তাঁদের প্রস্থানের নীতিমালা করুন।’ তিনি ঝুট ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাত তন্তুর ওপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবি জানান।

মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, ঢাকার (এমসিসিআই) সভাপতি কামরান টি রহমান বলেন, করপোরেট কর গত অর্থবছরে আড়াই শতাংশ কমানো হলেও নগদ লেনদেনবিষয়ক কিছু শর্ত থাকায় বেশির ভাগ কোম্পানি এ সুযোগ নিতে পারছে না। দেশে অনানুষ্ঠানিক খাত থাকায় নগদ লেনদেন হয়। শর্তটি বাতিল করা দরকার, যাতে বেশির ভাগ কোম্পানি সুযোগটি উপভোগ করতে পারে।

মুক্ত আলোচনায় কথা বলেন দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলা
ছবি: প্রথম আলো

দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলা কৃষি উন্নয়ন ও গবেষণায় কর ও সুদের হার কমানোর পরামর্শ দেন।

ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, অগ্রিম করের হার বেশি। আগে সমন্বয় করা গেলেও এখন যায় না। সে জন্য যে অগ্রিম কর নেওয়া হয়, তা ওই অর্থবছরেই সমন্বয়ের প্রস্তাব করেন তিনি।

বক্তব্য দেন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ফিকি) সভাপতি জাভেদ আখতার
ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী বিদেশি কোম্পানির শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ফিকি) সভাপতি জাভেদ আখতার ব্যবসার খরচ কমানোর ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, কাস্টমস, ভ্যাট ও ট্যাক্স—এই তিন বিভাগকে একটি সমন্বিত প্ল্যাটফর্মে আনা গেলে ব্যবসা সহজ হবে।

গাড়ি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বারভিডার সভাপতি হাবিবুল্লাহ ডন বলেন, ‘আমাদের ব্যবসায়ীদের রক্তক্ষরণ হচ্ছে। দুই বছর ধরে ডলারের উচ্চ মূল্য ও সুদের হার বেড়েছে। এতে গাড়ি আমদানির ব্যয় ৩০-৩৫ শতাংশ বেড়েছে। ফলে পুরোনো বা রিকন্ডিশন্ড গাড়ির দাম মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে গেছে। এমন প্রেক্ষাপটে গাড়ি আমদানিতে অবচয় হার ৩৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করা হলে গাড়ি মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসবে।’

করব্যবস্থা নিয়ে বক্তব্য দেন নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম
ছবি: প্রথম আলো

সিঙ্গাপুরে এক ভরি সোনা ৮৬ হাজার টাকায় পাওয়া গেলেও দেশে তা ১ লাখ ১৪ হাজার টাকা। সে জন্য দেশে সোনার দাম বেশি হওয়ার কারণ খতিয়ে দেখতে এনবিআরের প্রতি আহ্বান জানান গাজীপুর মেট্রোপলিটন চেম্বারের সভাপতি মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম। তিনি আরও বলেন, পণ্য আমদানিতে ছোটখাটো ভুলে ২০০ থেকে ৪০০ শতাংশ জরিমানা করা হচ্ছে। এতে ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়ছেন।

দেশের করব্যবস্থা বিনিয়োগ ও ব্যবসার পরিপন্থী বলে মন্তব্য করেন নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছ থেকে অগ্রিম আয়কর নেওয়া হয়। সেটি ফেরত বা সমন্বয় করা না হলে করপোরেটর কর আর ১২ শতাংশে থাকে না।’ তিনি আরও বলেন, আমদানি ও রপ্তানিতে শুল্ক কর্মকর্তাদের জরিমানা অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। অন্যায়ভাবে জরিমানা আদায় করা হচ্ছে।