চীন, ভারতসহ এশিয়ার বড় দেশগুলোর মূল্যস্ফীতি ২ শতাংশের নিচে, বাংলাদেশে ৮ শতাংশের বেশি

মূল্যস্ফীতিপ্রতীকী ছবি

আমেরিকায় যখন আবারও মূল্যস্ফীতির উত্তাপ বাড়ছে, তখন এশিয়ার অনেক দেশেই উল্টো প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। জাপান ও বাংলাদেশকে বাদ দিলে মহাদেশের শীর্ষ ১০ অর্থনীতিতে গড় মূল্যস্ফীতি এখন মাত্র ১ দশমিক ৩ শতাংশ। বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি এখনো ৮ শতাংশের ওপরে।

এশিয়ার বৃহত্তম ও পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীন ও থাইল্যান্ডে ভোক্তা মূল্য বরং কমেছে। ফিলিপাইনের মতো অন্য অর্থনীতিগুলোও মূল্যস্ফীতি নয়, উল্টো মূল্যহ্রাসের দিকে এগোচ্ছে। এমনকি সাধারণভাবে মূল্যস্ফীতিপ্রবণ ভারতেও জুলাই মাসে দাম বেড়েছে মাত্র ১ দশমিক ৬ শতাংশ; ২০১৭ সালের পর যা সবচেয়ে কম। কয়েকটি অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে আছে। তবে পাঁচটিতে ইতিমধ্যেই তা সেই সীমার নিচে। যেখানে ‘লক্ষ্যমাত্রার’ মধ্যে আছে, সেখানেও প্রবণতা স্পষ্টত নিম্নগামী। খবর দ্য ইকোনমিস্টের

অনেকের ধারণা, এর কারণ ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতি। তত্ত্বগতভাবে এ ধরনের শুল্ক এশিয়ার চাহিদায় ধাক্কা হওয়ার কথা—রপ্তানির দাম ও উৎপাদন দুটিই কমার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি; বরং শুল্ক কার্যকর হওয়ার আগে প্রতিষ্ঠানগুলো বাড়তি চালান পাঠিয়েছে, ফলে যুক্তরাষ্ট্রে অনেক এশীয় দেশের রপ্তানি উল্টো বেড়েছে। এশিয়ার এই নিম্ন মূল্যস্ফীতির ধারা শুরু হয়েছিল ২০২৪ সালের দ্বিতীয়ার্ধে, ট্রাম্প পুনর্নির্বাচিত হওয়ার আগেই। শুল্ক ভবিষ্যতে দাম নামিয়ে দিতে পারে ঠিক, কিন্তু বিষয়টি নিছক গত এক বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।

এই প্রবণতার বড় একটি কারণ হলো চীনের অতিরিক্ত উৎপাদন। দেশটিতে মূল্যহ্রাসের ধারা স্থায়ী হয়ে গেছে। একই সঙ্গে এর প্রভাব পড়ছে বাইরে—২০২২ সাল থেকে চীনের রপ্তানি মূল্যসূচক ১৫ শতাংশ কমেছে, অথচ রপ্তানি বেড়েছে। এর ঢেউ বিশ্বজুড়ে ছড়ালেও সবচেয়ে বেশি ধাক্কা খাচ্ছে এশিয়া। এই সময়ে এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে চীনের পণ্য বাণিজ্যের উদ্বৃত্ত প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। থাইল্যান্ডে গাড়ির দাম জুলাই পর্যন্ত ৬ শতাংশ কমেছে, কারণ বাজার দখল করছে সস্তা চীনা মডেল। ভিয়েতনাম ও সিঙ্গাপুরে চীনা স্মার্টফোন নির্মাতাদের প্রতিযোগিতার কারণে দাম কমেছে।

জ্বালানি ও খাদ্যের দামও কমেছে। ওপেক ও তার মিত্ররা উত্তোলন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ায় তেলের দাম স্থির আছে। এদিকে খাদ্যদ্রব্যের দামও এখন কমেছে, যদিও ইউক্রেন যুদ্ধ ও আবহাওয়াজনিত ক্ষতিতে কয়েক বছর ধরেই তা ঊর্ধ্বমুখী ছিল। ২০২৪ সালেও এশিয়ার শীর্ষ ১০ অর্থনীতিতে খাদ্যদ্রব্যের দাম গড়ে ৫ শতাংশ বেড়েছে (জাপান ও বাংলাদেশ বাদে)। জুলাই মাসে তা নেমে এসেছে ১ শতাংশে। এ পতন শুধু “বেজ ইফেক্ট” নয়, অর্থাৎ আগের বছরের উচ্চ দামকে ভিত্তি ধরে হিসাব করার ফল নয়; বরং চীনে অতিরিক্ত শূকর উৎপাদনের কারণে শূকরের মাংসের দাম কমেছে। সেই সঙ্গে এখন কর্মকর্তারা গৃহপালিত শূকরের সংখ্যা এক মিলিয়ন কমিয়ে এই প্রবণতা ঠেকানোর চেষ্টা করছেন।

এ ছাড়া এশিয়ার অনেক দেশে চাহিদা দুর্বল। দক্ষিণ কোরিয়ার মতো কিছু জায়গায় ব্যবসায়িক মন্দা চলছে। ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশে কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে উৎপাদন খাত প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। ফলে চাকরিচ্যুতি ঘটছে এবং ভোক্তা আস্থা কমছে। পুরো অঞ্চলে মজুরি বৃদ্ধির গতি শ্লথ হয়েছে। কয়েকটি দেশে শ্রমবাজারে প্রবেশকারীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় মজুরির ওপর চাপ পড়েছে। ফিলিপাইন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছেছে। ২০২২ সালের বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতার স্মৃতি হয়তো আরও বেশি মানুষকে কর্মক্ষেত্রে ঠেলে দিয়েছে।

এশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকাররাও পুনরাবৃত্তির ভয়ে ভীত। ফলে তাদের মুদ্রানীতিতে সাধারণভাবে অতিরিক্ত কড়াকড়ি দেখা যাচ্ছে; এটি মূলত চাহিদার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

দ্য ইকোনমিস্টের সংবাদে বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে ট্রাম্পের শুল্কনীতির কারণে এই নিম্ন মূল্যস্ফীতির ধারা আরও শক্তিশালী হবে। আমেরিকার চাহিদা কমে যাওয়ায় এশিয়ার রপ্তানি চাপে পড়বে। তখন বিকল্প বাজার খোঁজার দৌড় শুরু হবে। জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয়জনিত সংকটে ভোক্তারা নাজেহাল। ফলে তারা হয়তো দাম হ্রাসের বিষয়টিকে সুখবর বলে মনে করবেন; কিন্তু এগুলো বাস্তবে এশিয়ার দুর্বল অর্থনীতির লক্ষণ।

বাংলাদেশে উল্টো গতি

দেশে টানা তিন বছরের বেশি সময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। গত আগস্ট মাসে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। তারপরও গত মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ। গত জুলাই মাসে এই হার ছিল ৮ দশমিক ৫৫। গত আগস্ট মাসে যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে, তা গত ৩৭ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০২২ সালের জুলাই মাসে ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছিল। এরপর আর কখনো ৮ শতাংশের নিচে মূল্যস্ফীতি নামেনি।

অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে উচ্চ ভিতের ওপরেও উচ্চ হারে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে। সেই সঙ্গে কমেছে প্রবৃদ্ধির গতি। এ পরিস্থিতিতে বিশ্লেষকেরা বলেন, দেশের মূল্যস্ফীতি যতটা না চাহিদাজনিত, তার চেয়ে বেশি সরবরাহজনিত। অর্থাৎ বাজারব্যবস্থায় গলদ আছে। নিম্ন প্রবৃদ্ধির মধ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের কষ্ট বাড়ছে।