ক্ষমতাসীন ও দুর্নীতিবাজদের সুবিধা দেওয়ার বাজেট এটি: ফাহমিদা খাতুন

নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) ও সম্পাদক পরিষদ আয়োজিত অর্থনীতির চালচিত্র ও প্রস্তাবিত বাজেট ২০২৪-২৫’ শীর্ষক আলোচনায় বক্তব্য রাখছেন ফাহমিদা খাতুনছবি: প্রথম আলো

‘ক্ষমতাসীন ও দুর্নীতিবাজদের সুবিধা দেব, অন্যদেরও ছিটেফোঁটা এদিক-সেদিক দেব’—এমন অনুমিতি ও দর্শনের ওপর ভিত্তি করেই বাজেট করা হয়েছে বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, অন্যরা তা গ্রহণ করলে করুক, চিৎকার করলে করুক, তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই সরকারের। এসব পদক্ষেপের নৈতিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তি নেই। নৈতিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তিকে অবজ্ঞা করে বৈষম্যমূলক সমাজ সৃষ্টির কাজ করা হচ্ছে।

নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) ও সম্পাদক পরিষদ আয়োজিত ‘অর্থনীতির চালচিত্র ও বাজেট ২০২৪-২৫’ শীর্ষক আলোচনা সভায় ফাহমিদা খাতুন এসব কথা বলেন। আজ সোমবার রাজধানীর একটি হোটেলে এ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

সিপিডির (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, বাজেট বক্তব্যের শুরুর দিকে ভালো ভালো কথা থাকে। তা কাজে লাগানো হয় না। বরং সুবিধাবাদীদের স্বার্থ রক্ষায় করের প্রস্তাব দেওয়া হয়। এ ধরনের নৈতিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তিহীন দর্শন যে বাজেটে থাকে, তাতে সংবিধানে উল্লেখিত বৈষম্যহীন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তোলার মূল উদ্দেশ্য ধূলিসাৎ হয়ে যায়।

ফাহমিদা খাতুনের মতে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কথা শুনে যোগ-বিয়োগ করে নতুন বাজেট করা হয়েছে। এ বাজেটে সংস্কার পুরোপুরি অনুপস্থিত। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ছাড়া রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যাবে না। ১০ বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে, লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হচ্ছে না। বিদ্যমান কাঠামো দিয়ে বেশি রাজস্ব আহরণ সম্ভব নয়। এ ছাড়া করনীতি ও কর প্রশাসন এখনো আলাদা নয়। আবার অনেকে কর দিতেও চান, ভাবেন সৎভাবে বেঁচে থাকার কথা। কিন্তু তা নেওয়ার সক্ষমতা নেই সরকারের।

ব্যাংক খাতকে অর্থনীতির ‘প্রাণকেন্দ্র’ উল্লেখ করে ফাহমিদা খাতুন বলেন, বিভিন্ন খাতকে চলমান রাখার জন্য দরকার ভালো ব্যাংক খাত। অথচ খাতটি ভঙ্গুর থেকে ভঙ্গুরতর হয়ে গেছে। এ খাতে সাধারণ মানুষের জন্য কিছু নেই, আস্থাও নেই।

কিছু ব্যাংক আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে গড়িমসি করে বলে মন্তব্য করেন ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, এ খাতে চালু হয়েছে ঋণ পুনঃ তফসিল করার সংস্কৃতি এবং নতুন নতুন কায়দায় তা করা হচ্ছে। ২ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে বারবার পুনঃ তফসিল করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়া। এতে মানুষের আস্থার জায়গাটা ভেঙে গেছে। জনপ্রতিনিধিরা কীভাবে তা ফিরিয়ে আনবেন, সেটা একটা লক্ষ্য হওয়া উচিত।

ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘কর্মসংস্থান সৃষ্টির সক্ষমতা কমে গেছে অর্থনীতির। বলা হচ্ছে, বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। এ হিসাব কীভাবে করা হয়, তা তো আমরা জানি। সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করলেও তা যুক্ত হচ্ছে। বাস্তবে বেকারত্বের হার ১০ দশমিক ৬ শতাংশ। কিছুদিন আগে একটা পত্রিকায় এসেছে, চাকরির জন্য এসএসসি পাস দরকার, অথচ আবেদন বেশি এসেছে মাস্টার্স পাস।’

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, তারপরও যতটুকু প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তার বেশির ভাগই অনানুষ্ঠানিক খাত থেকে আসা। শিল্প খাতে ৯০ শতাংশের বেশি এবং সেবা খাতে ৬৭ শতাংশের বেশি অনানুষ্ঠানিক খাতের অবদান। অথচ অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মীদের আয় কম ও কাজের নিশ্চয়তা নেই।

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) প্রকল্প নিয়ে ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘এগুলো সময়মতো শেষ হয় না। অথচ অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে, ব্যয় হচ্ছে। এ খাতে জবাবদিহির সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। সরকারি সেবা দেব, কিন্তু জবাবদিহির বাইরে থাকব, তা ঠিক নয়। নিজেরা জবাবদিহির বাইরে থাকলে অন্যদের কীভাবে এর মধ্যে আনবেন?’

ফাহমিদা খাতুন বলেন, সঠিক সময়ে সঠিক নীতি দরকার। তবে সংকটের সময় অর্থনীতির মৌলিক নীতি অনুসরণ করা দরকার। মার্কিন ডলারের সঙ্গে চীন, ভারতসহ অনেক দেশই মুদ্রার মান কমিয়েছে। অথচ বাংলাদেশ কমায়নি।

সামাজিক নিরাপত্তা খাত নিয়ে ফাহমিদা খাতুন বলেন, এতে শুভংকরের ফাঁকি আছে। এ খাতের বরাদ্দ ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছে। পেনশন, সঞ্চয়পত্রের সুদ ও কৃষি ভর্তুকিকে বলা হয়েছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, যা উচিত নয়।