খাদ্যের বাড়তি খরচে ঋণ সংকটে পড়বে অনেক দেশ

২০২১ সালের জানুয়ারি মাসের তুলনায় ২০২২ সালের ২৯ জুলাই কৃষিপণ্যের মূল্যসূচক ১৯ শতাংশ বেড়েছে।

বিশ্বের অন্যতম প্রধান খাদ্য ও জ্বালানির ভান্ডার হচ্ছে ইউক্রেন ও রাশিয়া। কিন্তু দেশ দুটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় জ্বালানির পাশাপাশি খাদ্যের দামও তরতর করে বাড়ছে। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনের সূত্রে দ্য গার্ডিয়ান–এর এক সংবাদে বলা হয়েছে, যুদ্ধের কারণে অনেক ধনী দেশ উচ্চ মূল্যস্ফীতির কবলে পড়েছে।

বিশ্বব্যাংক বলেছে, পূর্ব-ইউরোপের দেশ রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় অনেক দেশের খাদ্য বাবদ অতিরিক্ত ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়াবে তাদের জিডিপির ১ শতাংশের সমান। কিছু দেশ এই অতিরিক্ত ব্যয়ভার মেটাতে সক্ষম হলেও অনেক দেশ ঋণসংকটে পড়বে। অর্থাৎ তাদের পক্ষে ওই বাড়তি ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব হবে না।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের কথা উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। বরা হয়েছে, জ্বালানি ও খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় বেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত ব্যয়ভার মেটাতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভান্ডারের(আইএমএফ) দ্বারস্থ হচ্ছে। তবে বাংলাদেশ ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণ চাইলেও বিদ্যমান ব্যবস্থায় ১০০ থেকে ১৫০ কোটি ডলার ঋণ মিলবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

যুদ্ধের প্রভাব তো আছেই, সেই সঙ্গে বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থার কারণেও পরিস্থিতির আরও অবনতি হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে লেবাননের কথা বলা হয়েছে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে। দেশটির রাজধানী বৈরুতে দুই বছর আগে খাদ্যগুদামে বিস্ফোরণ ঘটলে তাদের খাদ্য সংরক্ষণের সক্ষমতা বিনষ্ট হয়। এ বাস্তবতায় চলতি বছরের মার্চ-জুন সময়ে দেশটির খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৩৩২ শতাংশ। একই সময়ে আফ্রিকার দেশ জিম্বাবুয়ের খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ২৫৫ শতাংশ, ভেনেজুয়েলার ১৫৫ শতাংশ ও তুরস্কের ৯৪ শতাংশ। শুধু খাদ্য নয়, লেবাননের সামগ্রিক মূল্যস্ফীতিও কম নয়, ১৫০ শতাংশ। এ বাস্তবতায় বড় বিপাকেই পড়েছে দেশটির মানুষ।

বিশ্বব্যাংকের খাদ্যনিরাপত্তাবিষয়ক হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসের তুলনায় ২০২২ সালের ২৯ জুলাই কৃষিপণ্যের মূল্যসূচক ১৯ শতাংশ বেড়েছে। ভুট্টা ও গমের মূল্যসূচক যথাক্রমে ১৬ ও ২২ শতাংশ বেড়েছে। তবে চালের দাম বিশ্ববাজারে ১৪ শতাংশ কম।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বাড়তি। মার্চ থেকে জুন মাসের তথ্যে দেখা যায়, বিশ্বের প্রায় সব নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে মূল্যস্ফীতির হার বাড়তি। অনেক দেশেই তা দুই অঙ্কের ঘরে উঠেছে। উচ্চ আয়ের দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি—এই প্রবণতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায় ৭৯ শতাংশ উচ্চ আয়ের দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার অনেক বেশি।

খাদ্য আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি সারের মূল্যবৃদ্ধিকে আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিশ্বব্যাংক। সার উৎপাদনের প্রধান উপকরণ হচ্ছে প্রাকৃতিক গ্যাস। যুদ্ধের প্রভাবে প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ ইতিমধ্যে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি কমিয়েছে। এতে দেশের বেশ কয়েকটি সার কারখানার উৎপাদন অনেকটাই কমেছে। আবার যেসব দেশ সার আমদানি করে, তাদেরও উচ্চ মূল্যে সার আমদানি করতে হচ্ছে।

জাতিসংঘের আরেক হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী ৩০৭ কোটি মানুষের সুষম খাবার জোগাড়ের সামর্থ্য ছিল না। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ৪২ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্যকর খাবার থেকে বঞ্চিত। দেশের নিরিখে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা নেপালের। সে দেশের ৮৪ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্যকর খাবার জোগাড় করতে অপরাগ। এর পরে রয়েছে পাকিস্তান (৮৩ দশমিক ৫ শতাংশ), আফ্রিকা (৮০ শতাংশ), বাংলাদেশ (৭৩ দশমিক ৫ শতাংশ) ও ভারত (৭০ দশমিক ৫ শতাংশ)। এই বাস্তবতায় খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাওয়া বড় উদ্বেগর কারণ বলেই মানছেন বিশ্লেষকেরা।

বাংলাদেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের হিসাব অনুসারে, দেশের শহরাঞ্চলের প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলোর গড় মোট ব্যয়ের ৬১ দশমিক ৩১ শতাংশ যায় খাদ্যের পেছনে আর গ্রামীণ প্রান্তিক গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে তা ৬৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ। বিশ্বের সবখানেই চিত্রটি প্রায় একই রকম। অর্থাৎ প্রান্তিক মানুষের খাদ্য ব্যয় তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। সে জন্য খাদ্যের ব্যয় বৃদ্ধি পেলে এসব মানুষের পক্ষে খাদ্য গ্রহণ কমানো ছাড়া উপায় থাকে না। এতে তাদের স্বাস্থ্যে বড় ধরনের প্রভাব পড়ে, যা ভবিষ্যতে তাদের কর্মক্ষমতা হ্রাস করে।

গত মাসে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে জাতিসংঘ ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় চুক্তি হয়েছে। এর আওতায় কৃষ্ণ সাগরে আটকে থাকা শস্যবাহী ইউক্রেনের জাহাজ গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে যাবে। ইতিমধ্যে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বিশ্লেষকেরা আশা করছেন, এতে খাদ্যের দাম হয়তো কমতে শুরু করবে।