মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষ, বাড়তে পারে দারিদ্র্য

  • প্রকৃত আয় কমছে: মূল্যস্ফীতির তুলনায় মজুরি বাড়েনি।

  • অনানুষ্ঠানিকে খাতের ৬ কোটির বেশি মানুষ চাপে আছে

  • বিশ্বব্যাংক বলছে, ২০২৫ সালে অতিদরিদ্র হতে পারে ৩০ লাখ মানুষ।

প্রথম আলো ফাইল ছবি

মূল্যস্ফীতি কমানোই আগামী বাজেটের বড় চ্যালেঞ্জ। চাল, ডাল, আটা, ময়দা, তেল—সব নিত্যপণ্যই বেশি দামে কিনে খেতে হচ্ছে মানুষকে। দুই বছরের বেশি সময় ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজমান। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় কমছে। এতে দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা আছে।

২০২৪ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত টানা ১০ মাস মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের বেশি ছিল। এখন অবশ্য তা ৯ শতাংশের ঘরে নেমেছে। এত দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করায় সীমিত আয়ের মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে। সংসারের খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। অনেকে ধারদেনা করে সংসার চালাচ্ছে।

মূল্যস্ফীতির হার বাড়লে দারিদ্র্যসীমার একটু ওপরে থাকা মানুষের একটি অংশ আবার গরিব হয়ে যাবে—এমন আশঙ্কা থাকে। বিশ্বব্যাংক বলছে, খাদ্য মূল্যস্ফীতির কারণে ২০২৫ সালে আরও ৩০ লাখ মানুষ অতিদরিদ্র হয়ে যেতে পারে।

এমন অবস্থায় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আগামী সোমবার ২০২৫–২৬ অর্থবছরের বাজেট দিতে যাচ্ছে। অর্থনীতিবিদদের প্রত্যাশা, বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমানোর বিষয়ে উদ্যোগ থাকবে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণ মানুষ কষ্টে আছে। এই কষ্টের মধ্যেও অনেক সময় মানুষ সাময়িকভাবে কিছু মেনে নিতেও পারে। যেমন কম পণ্য কেনা বা খাবার কম খাওয়া; যাকে বলে ‘নেতিবাচকভাবে মানিয়ে’ নেওয়া। কিন্তু এখন যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তা দীর্ঘমেয়াদি হবে বলে মনে হচ্ছে। এতে মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে। তিনি আরও বলেন, ‘কোভিডের কারণে অনেকে গরিব হয়েছেন। আমরা তখন গবেষণা করে তা তুলে ধরেছি। এরপর কয়েক বছর ধরেই সাধারণ একটা প্রবণতা ছিল, বিনিয়োগ নেই, কর্মসংস্থান হচ্ছে না, তরুণেরা কাজ পাচ্ছে না। সেই সঙ্গে এখন রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।’

মূল্যস্ফীতি নিয়ে যে শুধু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বিপাকে পড়েছে, তা নয়। গত আওয়ামী লীগ সরকারও প্রায় দুই বছরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। অবশ্য আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মূল্যস্ফীতির সমস্যা স্বীকৃতিই দেওয়া হয়নি। সে জন্য মূল্যস্ফীতির কমানো যায়নি। ফলে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার উত্তরাধিকার সূত্রে উচ্চ মূল্যস্ফীতি পেয়েছে।

গত ৭-৮ মাসের নানা উদ্যোগে ডলার–সংকট প্রায় সামাল দিতে পেরেছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। ফলে ভোগ্যপণ্য আমদানি স্বাভাবিক হয়েছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে কমছে না। বাজার তদারকি নেই; চাঁদাবাজিও বন্ধ হয়নি—এমন অনেক কারণেই তা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অভ্যন্তরীণ বাজার কঠোর তদারকি করে দেশে উৎপাদিত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঠেকানো সম্ভব। প্রয়োজনে চালের দাম সহনীয় রাখতে বাজার কৌশল নির্ধারণ করা। পাশাপাশি উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত গরিব মানুষকে বাজেটের মাধ্যমে নগদ ও খাদ্যসহায়তা দিয়ে সুরক্ষা দিতে হবে।

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। এনবিআরও তেল, আলু, পেঁয়াজ, ডিমসহ বেশ কিছু নিত্যপণ্যে শুল্ক-কর কমিয়ে দেয়। বাজারে নিত্যপণ্যের আমদানিপ্রবাহ ঠিক রাখার চেষ্টা করা হয়। তবে পথেঘাটে চাঁদাবাজি তেমন একটা বন্ধ হয়নি বলে ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করছেন।

কয়েক বছর ধরে বিবিএসের মূল্যস্ফীতির তথ্য নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে আসছেন অর্থনীতিবিদেরা। তাঁরা বলছেন, সরকারি পরিসংখ্যানে মূল্যস্ফীতির যে হিসাব দেওয়া হচ্ছে, বাস্তবে তা আরও বেশি। সরকার মূল্যস্ফীতি কমিয়ে দেখাচ্ছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারকেরা দাবি করছেন, বিবিএস এখন সঠিক পরিসংখ্যান প্রকাশ করছে।

গত ১০ মাসের চিত্র

চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস (জুলাই-ডিসেম্বর) সার্বিক মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে ছিল। পরের চার মাস অর্থাৎ এপ্রিল পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ঘরে ছিল।

তবে আশঙ্কার বিষয় হলো খাদ্য মূল্যস্ফীতি। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) পর্যন্ত খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের বেশি ছিল। এর মধ্যে গত জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে ওঠে, যা গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। তবে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি পুরো ১০ মাস ধরে ৯ শতাংশের ঘরে আছে।

তবে ২০২৪ সালের ১২ মাসের মধ্যে মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সার্বিক মূল্যস্ফীতি টানা দশ মাস ধরে ১০ শতাংশের ওপরে ছিল। এত দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করায় সাধারণ মানুষ বা সীমিত আয়ের মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে।

যেসব পণ্যের দাম বেড়েছে

গত এক বছরে প্রায় সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। তবে মূল্যবৃদ্ধির আলোচনায় ছিল চাল, তেল, আলু, পেঁয়াজ, ডিম ইত্যাদির। বাংলাদেশ ট্রেডিং করপোরেশনের (টিসিবি) হিসাবে, গত এক বছরে মোটা চালের দাম বেড়েছে ৫ শতাংশ। এখন কেজিপ্রতি ৫০ টাকার কমে মোটা চাল পাওয়া যায় না। অন্য চালের দাম এক বছরে ১০-১১ শতাংশ বেড়েছে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুসারে, এখন মূল্যস্ফীতিতে চালের অবদান ২০ শতাংশের মতো, একক পণ্য হিসেবে যা সর্বোচ্চ। তাই চালের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতিতে বেশি প্রভাব পড়ে।

গত এক বছরে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে ১২ থেকে ২২ শতাংশ। এ ছাড়া এক বছরে দাম বেড়েছে পেঁয়াজের; বছরের মাঝখানে বেড়ে আবার কমেছে। রসুনেরও একই অবস্থা। ডিমের দাম ডজনপ্রতি দাম ১৬০–১৭০ টাকা হয়েছিল। এ ছাড়া মাছ, মাংসের দামও বেড়েছে ৫-১০ শতাংশ।

প্রকৃত মজুরি কমেছে

মূল্যস্ফীতি একধরনের কর। ধরা যাক, সংসার চালাতে কারও বেতনের পুরোটা খরচ হয়ে যায়। কিন্তু হঠাৎ জিনিসপত্রের দাম বাড়লে এবং সে অনুযায়ী আপনার আয় না বাড়লে আপনাকে ধারদেনা করে সংসার চালাতে হবে কিংবা খাবার, কাপড়চোপড়, যাতায়াতসহ বিভিন্ন খাতে কাটছাট করতে হবে। মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধি বা আয় বৃদ্ধি কম হলে সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়ে। প্রকৃত আয় কমে যায়।

এর মধ্যে মানুষের মজুরি মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বাড়েনি। এক বছর ধরে (২০২৪ সালের মে মাস থেকে ২০২৫ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত) গড় মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের বেশি, ১০ দশমিক ২১ শতাংশ। কিন্তু এক বছরে কোনো মাসেই জাতীয় গড় মজুরি বৃদ্ধির হার ৯ শতাংশ পেরোয়নি। মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি হার কম হওয়ায় মানুষের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমেছে।

মজুরিনির্ভর বিশাল জনগোষ্ঠীর ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি পড়ে। গ্রাম-শহরনির্বিশেষে ১৪৫টি নিম্ন দক্ষতার পেশার মজুরি নিয়ে এই হিসাব করে বিবিএস। বিবিএস বলছে, দেশের প্রায় ৮৬ শতাংশ মানুষ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। এমন কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা ছয় কোটির মতো। এই শ্রেণির মানুষের অনিশ্চয়তা বেশি।

দারিদ্র্য বাড়তে পারে

অর্থনীতির হালনাগাদ পরিস্থিতি নিয়ে গত এপ্রিল মাসে ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। বাংলাদেশে এ বছর আরও ৩০ লাখ মানুষ ‘অতিদরিদ্র’ হবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। অতিদারিদ্র্যের হার বেড়ে ৯ দশমিক ৩ শতাংশ হবে। ২০২৪ সালে এই হার ছিল ৭ দশমিক ৭ শতাংশ।

বিশ্বব্যাংক মনে করে, অতিদরিদ্র বেড়ে যাওয়ার মূলত তিনটি কারণ। কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্রমাগত প্রকৃত আয় কমে যাওয়া, দুর্বল শ্রমবাজার ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মন্থর গতি।

এ দেশে সার্বিক দারিদ্র্যসীমার মানদণ্ড এ রকম—খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্য এবং সেবা কেনার জন্য একজন মানুষের প্রতি মাসে গড়ে ৩ হাজার ৮২২ টাকা খরচ করার সামর্থ্য যদি না থাকে, তাহলে তিনি দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবেন বা গরিব হয়ে যাবেন। এটি সার্বিক দারিদ্র্যরেখা। এর পাশাপাশি দারিদ্র্য পরিমাপে ১১৯ ধরনের বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় নেন বিবিএস কর্মকর্তারা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২ অনুসারে (২০২৩ সালে প্রকাশিত) দেশে এখন সার্বিক দারিদ্র্যের হার ২০ শতাংশ। গ্রাম এলাকার দারিদ্র্য ছিল ২০ দশমিক ৩ শতাংশ এবং শহর এলাকায় ১৭ দশমিক ৭ শতাংশ।