বিদেশি চাপ বাড়লেও ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন-চর্চায় প্রতিবন্ধকতা কাটছে না কেন

ফাইল ছবি

সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন গত বছর ১০টি তৈরি পোশাক কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিল। নিয়মকানুন মেনে আবেদন করলেও তাদের সবগুলো আবেদনই বাতিল হয়ে যায়। তার বিপরীতে কারখানাগুলোর অন্য শ্রমিকেরা আবেদন করে ট্রেড ইউনিয়নের নিবন্ধন পেয়েছেন।

এমন অভিযোগ করে সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের আবেদন বাতিল হলেও মালিকপক্ষ নিজেদের লোকজন দিয়ে আবেদন করে ইউনিয়ন নিবন্ধন পেয়েছে। শ্রম দপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও শ্রমিক নামধারী কিছু লোক যোগসাজশে এসব কাজ করছে।’ তিনি আরও বলেন, কোনো কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন পেলে সেখানকার ইউনিয়ন নেতাদের চাকরিচ্যুতি বা পেছনে গুন্ডাপান্ডা লাগিয়ে দেওয়া নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে।

ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনে আইন ও আইনবহির্ভূত বাধার কথা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছেন শ্রমিকনেতারা। তাঁরা বলছেন, ইউনিয়ন নিবন্ধনের সংখ্যা বাড়লেও কারখানায় প্রকৃত ইউনিয়ন বাড়ছে না। সে কারণে নিবন্ধনের পর অধিকাংশ ইউনিয়ন নিষ্ক্রিয় থাকছে। ফলে শ্রমিক অধিকার ও যৌথ দর-কষাকষিতে কোনো উন্নতি হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন ও চর্চায় প্রতিবন্ধকতাই হচ্ছে মৌলিক সমস্যা।

এদিকে ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন সহজীকরণ করার পাশাপাশি শ্রম অধিকার উন্নয়নে বিদেশি চাপ বাড়ছে। শুধু তা-ই নয়, বিষয়টি আইনকানুনের মধ্যে নিয়ে আসতে শুরু করেছে পশ্চিমা দেশগুলো। তারই অংশ হিসেবে গত সপ্তাহে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট পণ্য সরবরাহ ও বিপণনের সার্বিক প্রক্রিয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘন ও পরিবেশের ক্ষতি বন্ধে কোম্পানিগুলোর পদক্ষেপ গ্রহণে বাধ্যবাধকতা আরোপ করে নতুন একটি বিধান পাস করেছে। এতে করে স্বাধীনভাবে শ্রম সংগঠন নিবন্ধন ও চর্চা এবং যৌথ দর-কষাকষির ক্ষেত্রে দুর্বলতার থাকলে চ্যালেঞ্জে পড়বে যেকোনো দেশ।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র বলেছে যে বাংলাদেশের শ্রম অধিকার পরিস্থিতির আরও উন্নয়ন হলে বাংলাদেশে দেশটির বিনিয়োগ বাড়বে। এ জন্য মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি দপ্তরের (ইউএসটিআর) দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া অঞ্চলের একটি দল একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছে। এতে মোটাদাগে ১১টি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেই কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কৌশল নিয়ে গত মাসের চতুর্থ সপ্তাহে তারা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকও করেছে।

ইউএসটিআরের কর্মপরিকল্পনার প্রথমটি হচ্ছে, ট্রেড ইউনিয়ন নেতা, শ্রমিক ও শ্রম অধিকারকর্মীদের যাঁরা নিপীড়ন করেন ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালান, তাঁদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এরপরই রয়েছে শ্রমিকনেতা ও শ্রমিকদের বিরুদ্ধে কাজ করে, এমন কারখানার মালিক ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহির আওতায় আনা। এ ছাড়া ইউএসটিআর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ট্রেড ইউনিয়নগুলো যে মানের অধিকার ভোগ করে, সে অনুযায়ী বাংলাদেশের শ্রম আইনের সংশোধন চায়। তারা বলেছে, বাংলাদেশের রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলগুলোর (ইপিজেড) শ্রমিকেরা যাতে পুরোদমে ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারেন, সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

জানতে চাইলে জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, মজুরি বাড়ানোর আন্দোলন নিয়ে অনেক ধরনের ঘটনা ঘটেছে। স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়নের চর্চা থাকলে এসব ঘটনা এড়ানো যেত। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ইপিজেডে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার পূর্ণ অধিকার চাই। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের কথা বলে শ্রমিকদের খর্ব করার পক্ষে নই আমরা।’

১৯৮৩ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ৩০ বছরে মাত্র ১৩৮টি ট্রেড ইউনিয়ন গঠিত হয়। অবশ্য রানা প্লাজা ধসের পর পরিস্থিতি বদলে যায়। আন্তর্জাতিক চাপে একের পর এক ট্রেড ইউনিয়নের নিবন্ধন হওয়া শুরু হয়। ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে এক শর বেশি ইউনিয়ন নিবন্ধিত হয়েছে। বর্তমানে দেশে ১ হাজার ২০০-এর বেশি ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন হয়েছে। তার মধ্যে তৈরি পোশাকশিল্পই বেশি।

জানতে চাইলে নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, তৈরি পোশাকশিল্পে রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন অথবা বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ট্রেড ইউনিয়ন করছে। এতে করে ইউনিয়ন গঠন করার পরই সেগুলোর কোনো কার্যকারিতা থাকে না। উল্টো তারা শিল্পের স্বার্থের বদলে নিজেদের আদর্শের চর্চা করে।

মোহাম্মদ হাতেম আরও বলেন, ‘অতীতে ট্রেড ইউনিয়নের কিছু অনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য মালিকদের মধ্যে ইউনিয়ন নিয়ে একধরনের ভীতি কাজ করে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে তাঁরাও ইউনিয়ন করার বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে নিতে চান না। তবে গত এক দশকে মালিকের মনোভাবের অনেক পরিবর্তন হয়েছে।’ তিনি বলেন, দায়িত্বশীল ট্রেড ইউনিয়ন হলে মালিকদের কোনো আপত্তি নেই। তবে সে ক্ষেত্রে মালিক ও শ্রমিক উভয় পক্ষের দায়িত্ববান হতে হবে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিসের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশে ট্রেড ইউনিয়ন যথাযথভাবে কাজ করছে না। এতে করে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। শ্রমিকদের সংগঠন করার অধিকার বাস্তবায়িত না হওয়ায় আমরা প্রথম ধাপ থেকে দ্বিতীয় ধাপে অর্থাৎ যৌথ দর-কষাকষিতে উত্তরণ হচ্ছে না।’ বাংলাদেশে ট্রেড ইউনিয়ন চর্চার পরিবেশ নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের ক্ষেত্রে এখনো ২০ শতাংশ শ্রমিকের সম্মতির বাধ্যবাধকতার বিষয়টি রয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত সেবা খাত, নির্মাণসহ অধিকাংশ খাতে ট্রেড ইউনিয়ন নেই। এসব খাতের শ্রমিকদের অধিকার পূরণ হচ্ছে না। ফলে আইনকানুন সহজীকরণের মাধ্যমে ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন ও চর্চা সহজ আর স্বাধীন করতে হবে।