চাকরিতে বেশি সময় দেন বিবাহিতরা

দেশে নারী–পুরুষ মিলিয়ে এক দিনে ২৪ ঘণ্টার ১১ ঘণ্টা ৬ মিনিটই ব্যয় করে থাকেন নিজেদের যত্ন–আত্তি ও পরিচর্যায়।

দেশের মানুষ (নারী–পুরুষ মিলিয়ে) দিনের একটি বড় অংশই নিজের যত্ন–আত্তি ও পরিচর্যায় ব্যয় করেন। এ জন্য তাঁরা সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় করে থাকেন। এক দিনে ২৪ ঘণ্টার ১১ ঘণ্টা ৬ মিনিটই মানুষ ব্যয় করেন নিজের যত্ন ও পরিচর্যায়। এটি নারী–পুরুষের গড় সময়। আলাদা হিসাবে দেখা যায়, পুরুষেরা দিন ১১ ঘণ্টা ১৮ মিনিট ব্যয় করেন নিজের যত্ন–আত্তি ও পরিচর্যায়। নারীর ক্ষেত্রে এ সময় ১০ ঘণ্টা ৫৪ মিনিট।

সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘সময় ব্যবহার বা টাইম ইউজ জরিপ–২০২১’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। নিজের যত্ন–আত্তি ও পরিচর্যার এই হিসাবের মধ্যে ঘুমের সময়টুকুও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

জরিপটি ২০২১ সালের হলেও এ নিয়ে বিবিএস পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করে গত মাসে। এ জরিপে দিনের ২৪ ঘণ্টা মানুষ কীভাবে ব্যয় করেন, তার বিস্তারিত তথ্য উঠে এসেছে। জাতিসংঘ বা ইউএন ওমেনের সহায়তায় জরিপটি করেছে বিবিএস। দেশের আটটি বিভাগের আট হাজার পরিবারের ওপর এ জরিপ করা হয়। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৪৯ দশমিক ৭ শতাংশ ছিলেন পুরুষ, আর ৫০ দশমিক ৩ শতাংশ ছিলেন নারী। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে প্রায় ৪২ শতাংশের বয়স ছিল ২৫ থেকে ৪৪ বছর, ২৪ শতাংশ ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী, সাড়ে ১৪ শতাংশ ৪৫ থেকে ৫৪ বছর বয়সী, ১১ শতাংশ ৫৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী ও বাকি প্রায় ৯ শতাংশ ৬৫ বছরের বেশি বয়সী।

নারীর ৬ ঘণ্টার কাজ বিনা পারিশ্রমিকে

বিবিএসের জরিপের তথ্য অনুযায়ী, নিজের যত্ন–আত্তি ও পরিচর্যার পর মানুষ বেশি সময় ব্যয় করেন কর্মসংস্থান তথা চাকরিসংশ্লিষ্ট কাজে। এ জন্য নারী ও পুরুষ মিলিয়ে গড়ে ব্যয় করেন ৩ ঘণ্টা ১৮ মিনিট। তবে আলাদাভাবে বিবেচনা করলে এ ক্ষেত্রে নারীর তুলনায় প্রায় পাঁচ গুণ বেশি সময় ব্যয় করেন পুরুষ। নারীরা কর্মসংস্থানসংশ্লিষ্ট কাজে ব্যয় করেন দিনের মাত্র ১ ঘণ্টা ১২ মিনিট। এর বিপরীতে পুরুষেরা ব্যয় করেন ৬ ঘণ্টা ৬ মিনিট। পুরুষেরা যখন কর্মসংস্থানসংশ্লিষ্ট কাজে দিনের একটি বড় সময় ব্যয় করেন, তখন নারীরা তাঁদের দিনের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সময় ব্যয় করেন বিনা পারিশ্রমিকে করে যাওয়া গৃহস্থালির কাজ ও পরিবারের সদস্যদের পেছনে। একজন নারী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৪ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট ব্যয় করেন গৃহস্থালি কাজে। এর মধ্যে ৩ ঘণ্টা ১৯ মিনিটই ব্যয় হয় রান্নাবান্নার কাজে। গৃহস্থালি কাজে পুরুষ ব্যয় করেন মাত্র ৩৬ মিনিট। এ ছাড়া নারীরা পরিবারের লোকজনের সেবাযত্ন বা দেখাশোনার পেছনে ১ ঘণ্টা ১২ মিনিট ব্যয় করেন বিনা পারিশ্রমিকে।

জরিপের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, নারীরা গৃহস্থালি ও পরিবারের লোকজনের দেখাশোনা মিলিয়ে পারিবারিক কাজে দিনে ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট সময় ব্যয় করেন। কিন্তু তার বিনিময়ে তাঁরা কোনো পারিশ্রমিক পান না। ফলে নারীদের এসব কাজের কোনো আর্থিক মূল্য নেই। এ কারণে অর্থনীতি বা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) হিসাবে নারীর এ কাজের কোনো অবদান হিসাবে ধরা হয় না। দীর্ঘদিন ধরে অর্থনীতিবিদেরা নারীর গৃহস্থালি কাজকে জিডিপির হিসাবে যুক্ত করার দাবি জানিয়ে আসছেন।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইন অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রে আমাদের কাজের সময় ৮ ঘণ্টা। সেখানে দেখা যাচ্ছে, নারীদের প্রায় ছয় ঘণ্টার কাজের কোনো মূল্যই অর্থনীতির কোনো হিসাবে যুক্ত হচ্ছে না। নারীরা যেসব কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকেন, তার যদি বিকল্প ব্যবস্থা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে করা হতো, তাহলে নারীরা আরও বেশি পরিমাণে শ্রমবাজারে যুক্ত হতে পারতেন। অর্থনীতিতেও তার সুফল পাওয়া যেত। এ জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দিবাযত্নকেন্দ্র বা প্রবীণ নিবাসের মতো সহায়তা ব্যবস্থা তৈরি করা দরকার।’

ফাহমিদা খাতুন আরও বলেন, শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষার দিক থেকে মূল্যবোধেরও পরিবর্তন দরকার। তাহলে পরিবারের বিনা পারিশ্রমিকের কাজে নারীর পাশাপাশি অন্যরাও এগিয়ে আসবেন। তাতে নারীর বিনা পারিশ্রমিকের কর্মঘণ্টা কমে আসবে এবং ধীরে ধীরে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ আরও বাড়বে। 

চাকরিতে বেশি সময় দেন রংপুরের মানুষ

জরিপে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, চাকরির পেছনে সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় করেন রংপুর বিভাগের মানুষ। এ বিভাগের মানুষ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গড়ে ৪ ঘণ্টা ৬ মিনিট সময় ব্যয় করেন চাকরির পেছনে। এর পরের অবস্থানে রয়েছে ঢাকা বিভাগের মানুষ। এ বিভাগের মানুষেরা গড়ে দিনে ৩ ঘণ্টা ৫৮ মিনিট ব্যয় করেন চাকরির পেছনে। চাকরির পেছনে সময় ব্যয়ের দিক থেকে এর পরের অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে খুলনা, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, ময়মনসিংহ ও রাজশাহী বিভাগের মানুষ। কর্মসংস্থান তথা চাকরিসংশ্লিষ্ট কাজের পেছনে সবচেয়ে কম সময় ব্যয় করেন রাজশাহীর মানুষেরা। তাঁরা দিনে ২ ঘণ্টা ১৪ মিনিট সময় চাকরির পেছনে ব্যয় করেন।

বিবাহিতরা চাকরিতে বেশি সময় দেন

বিবাহিত নাকি অবিবাহিত মানুষ—কে চাকরির পেছনে বেশি সময় ব্যয় করেন, সে তথ্যও সংগ্রহ করা হয়েছে বিবিএসের জরিপে। তাতে দেখা যাচ্ছে, বিবাহিত নারী–পুরুষ উভয়ই চাকরির পেছনে বেশি সময় ব্যয় করেন অবিবাহিতদের তুলনায়। এর মধ্যে বিবাহিত পুরুষেরা দিনে ৬ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ব্যয় করেন চাকরির পেছনে, যেখানে অবিবাহিত পুরুষেরা ব্যয় করেন ৩ ঘণ্টা ৫৪ মিনিট। অর্থাৎ অবিবাহিত পুরুষের তুলনায় বিবাহিত পুরুষেরা চাকরির পেছনে প্রায় দ্বিগুণ সময় ব্যয় করেন।

বিবাহিত নারীরা চাকরির পেছনে গড়ে ১ ঘণ্টা ১২ মিনিট সময় ব্যয় করেন, যেখানে অবিবাহিত নারীরা ব্যয় করেন ১ ঘণ্টা ৬ মিনিট। অবিবাহিত নারীদের তুলনায় বিবাহিত নারীরা গৃহস্থালি কাজেও বেশি সময় ব্যয় করেন। বিবাহিত নারী দিনে ৫ ঘণ্টা ১৮ মিনিট ব্যয় করেন গৃহস্থালি কাজে। অন্যদিকে অবিবাহিত নারীরা গৃহস্থালি কাজে সময় দেন দিনে ২ ঘণ্টা ১৮ মিনিট।

বিবিএসের জরিপ বলছে, নারী ও পুরুষ দিনে তৃতীয় সর্বোচ্চ সময় ব্যয় করেন সংস্কৃতি, অবসর ও পত্রপত্রিকা পড়া এবং খেলাধুলার পেছনে। এ জন্য দিনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ২ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট ব্যয় হয় তাঁদের। এ ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীরা বেশি সময় ব্যয় করেন। নারীরা দিনে ২ ঘণ্টা ৪২ মিনিট সময় ব্যয় করেন, আর পুরুষেরা করেন ২ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট। জরিপের তথ্য বলছে, নারী–পুরুষ উভয়ই সবচেয়ে কম সময় ব্যয় করেন বিনা পারিশ্রমিকের স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে। দিন–রাত মিলিয়ে ২৪ ঘণ্টায় এ কাজে মানুষ ব্যয় করেন মাত্র ৬ মিনিট। এর পরে সবচেয়ে কম সময় মানুষ ব্যয় করেন জ্ঞানার্জনে। নারী–পুরুষ মিলিয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মাত্র ১৮ মিনিট জ্ঞানার্জনের পেছনে ব্যয় করেন।