বিবিএসের উদ্যোগ
মূল্যস্ফীতির তথ্যে হঠাৎ তদারকি
মাঠপর্যায়ে জিনিসপত্রের দাম যাচাই-বাছাইয়ের জন্য প্রধান কার্যালয়ের ২৫ কর্মকর্তার সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে একটি দল।
ছয় মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের ওপরে। এভাবে দীর্ঘ সময় ধরে ৬ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতি থাকার নজির গত এক দশকে দেখা যায়নি। সর্বশেষ গত জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। চলতি মাসে জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ বাড়ানোর পর প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্যের দামই বেড়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে মূল্যস্ফীতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা নিয়ে
রয়েছে সংশয়। অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ শঙ্কা প্রকাশ করেছেন, মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘর ছাড়িয়ে যেতে পারে।
এদিকে মূল্যস্ফীতি গণনায় হঠাৎ করেই নজরদারি বাড়িয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। চলতি আগস্ট মাসের শুরুতে মাঠপর্যায়ের তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করতে প্রধান কার্যালয়ের ২৫ জন কর্মকর্তার একটি দল তৈরি করে সংস্থাটি। প্রত্যেক কর্মকর্তা দুটি করে মোট ৫০টি জেলার মাঠপর্যায়ে জিনিসপত্রের দাম যাচাই-বাছাই করছেন।
এমনিতেই দেশের অর্থনীতিবিদেরা বিবিএসের মূল্যস্ফীতির তথ্য নিয়ে অনেক দিন ধরেই শঙ্কা প্রকাশ করে আসছেন। তাঁদের দাবি, সংস্থাটি বর্তমানে মূল্যস্ফীতির যে হিসাব দিচ্ছে, বাস্তবে তার চেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতি রয়েছে দেশে। সে কারণেই হঠাৎ করে জিনিসপত্রের দাম তদারকিতে বিবিএসের উদ্যোগ নিয়ে কৌতূহল তৈরি হয়েছে। তবে কেউ কেউ বলছেন, এতে তথ্যের সত্যতা আরও বেশি নিশ্চিত হতে পারে। তাঁদের মতে, অনেক সময় মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা সঠিক তথ্য পাঠান না।
তদারকির দায়িত্বে থাকা বিবিএসের কর্মকর্তারা বলছেন, মাঠপর্যায়ের কর্মীরা জিনিসপত্রের দাম বেশি বা কম লিখলে তা ঠিক করে দিচ্ছেন প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তারা। এতে চলতি মাসে মূল্যস্ফীতির প্রকৃত চিত্র উঠে আসবে বলে দাবি তাঁদের।
আগস্ট মাসে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের বেশি হবে বলে আমর ধারণা। কারণ, মূল্যস্ফীতি গণনায় খাদ্যপণ্যের ভার ৬০ শতাংশের মতো। আবার খাদ্যপণ্যের মধ্যে চালের ভার ৪০ শতাংশের মতো।
এদিকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর মূল্যস্ফীতি নিয়ে দুশ্চিন্তা বেড়ে গেছে নতুন করে। গত সপ্তাহে অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) এক অনুষ্ঠানে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, চলতি মাসে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই বড় চ্যালেঞ্জ। তবে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়াই করতে সরকারের কার্যকর হাতিয়ার নেই। তাঁর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, ‘অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা আমরা খুব একটা গুরুত্বসহকারে নিই না। মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে হয় না।’
বিবিএস জাতীয় পর্যায়ে এবং গ্রাম ও শহরাঞ্চলের জন্য ভোক্তা মূল্যসূচক (কনজ্যুমার প্রাইস ইনডেক্স বা সিপিআই) হিসাব করে। এই সূচকগুলো ব্যবহার করে শহর, গ্রাম ও জাতীয় পর্যায়ে মূল্যস্ফীতির হিসাব করা হয়। শহর ও গ্রামের গড় আয়ের পরিবারগুলোর ওপর ভিত্তি
করে তৈরি করা হয় ভোক্তা মূল্যসূচক। এ ক্ষেত্রে শহর ও গ্রামের জন্য দুটি আলাদা ভোগ্যপণ্যের তালিকা বা কনজ্যুমার বাস্কেট রয়েছে। শহরের ভোক্তাদের এই তালিকায় আছে খাদ্য, অন্য নানা ব্যবহার্য জিনিসসহ ৪২২টি পণ্য। আর গ্রামের ভোক্তাদের তালিকায় আছে ৩১৮টি পণ্য। ভোক্তা মূল্যসূচক তৈরি করতে কোন পণ্যের গড় মান (পরিসংখ্যানের ভাষায় যাকে বলা হয় ওয়েট) কত হবে, সেটি বিবিএস নির্ধারণ করে একটি পরিবারের মোট খরচের কত অংশ কোন পণ্যের পেছনে যায়, তার ভিত্তিতে। আর পরিবারগুলোর অর্থ ব্যয় বা ভোগের ধরন নিরূপণ করা হয় ২০০৫-০৬ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপের ভিত্তিতে।
ঢাকার খাদ্য ও অন্যান্য পণ্যের তালিকায় রয়েছে চাল, আটা, ডাল, চিনি, মাছ, মাংস, ডিম, শর্ষে ও সয়াবিন তেল, বিভিন্ন ধরনের মাছ ও মাংস, ডিম, পেঁয়াজ, হলুদ, আদা, লবণ, আলু, তরল ও গুঁড়া দুধ, নারকেল তেল, শাড়ি-লুঙ্গি, সিমেন্ট, সাদা কাগজ ইত্যাদি।
মূল্যস্ফীতি গণনায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে চালের দাম। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে চালের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যানুযায়ী, ঢাকার বাজারে গত ২৮ জুলাই মোটা চালের কেজি ছিল ৪৮-৫০ টাকা। গতকাল সেই চাল বিক্রি হয়েছে ৫৫-৬০ টাকা। তার মানে, চালের দাম বেড়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ। এ ছাড়া খোলা আটার দাম ২৮ শতাংশ বেড়েছে। এ ছাড়া সয়াবিন তেল, ডিম, মাছ-মাংস, শাকসবজিসহ সবকিছুর দামই বেড়েছে। অন্যদিকে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ঢাকার ভেতরে গণপরিবহনে প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া বেড়েছে ৩৫ পয়সা।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিবিএসের তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের উদ্যোগটি ভালোও হতে পারে, খারাপও হতে পারে। বিবিএসের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে এমনিতেই অসংগতি আছে। আগস্ট মাসে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের বেশি হবে বলে আমর ধারণা। কারণ, মূল্যস্ফীতি গণনায় খাদ্যপণ্যের ভার ৬০ শতাংশের মতো। আবার খাদ্যপণ্যের মধ্যে চালের ভার ৪০ শতাংশের মতো। এর মানে, সার্বিক মূল্যস্ফীতি গণনায় চালের ভার ২৪ শতাংশের মতো। চালের দাম ১০ শতাংশ বাড়লে তাতে সার্বিক মূল্যস্ফীতি এমনিতেই ২ দশমিক ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে পরিবহনসহ অন্য পণ্যের দামও বেড়েছে।
বিবিএসের জাতীয় আয় শাখার সংশ্লিষ্ট বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, মাঠ পর্যায় থেকে যাতে জিনিসপত্রের দামের সঠিক তথ্য আসে, তা যাচাই-বাছাই করতে প্রধান কার্যালয় থেকে কর্মকর্তারা যাচ্ছেন। এখন থেকে নিয়মিতভাবে এই তদারকি চলবে। তিনি জানান, আগস্ট মাসের মূল্যস্ফীতির গণনা প্রথম সপ্তাহেই চূড়ান্ত করা হবে। পরবর্তীকালে তাতে চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হবে।