শুল্কের প্রভাব পড়বে ১ হাজার ৩২২ কারখানায়

  • যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে গড়ে ১৫% শুল্ক দিয়ে পণ্য রপ্তানি করে আসছিল বাংলাদেশ।

  • নতুন হার কার্যকর হলে তখন মোট শুল্ক দাঁড়াবে ৫০%।

  • বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের একক বৃহত্তম বাজার যুক্তরাষ্ট্র।

  • ব্যবসায়ীরা দর–কষাকষির সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন।

ঢাকার একটি তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করছেন নারীরাফাইল ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের ওপর উচ্চ হারে পাল্টা শুল্ক আরোপ করলে বিজিএমইএর সদস্যভুক্ত ১ হাজার ৩২২টি পোশাক কারখানার ওপর প্রভাব পড়বে। এসব কারখানা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রপ্তানি করে, কেউ বেশি কেউ কম।

পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ এই হিসাব তৈরি করেছে। সংগঠনটি জানিয়েছে, তাদের সদস্যদের মধ্যে সচল পোশাক কারখানার সংখ্যা আড়াই হাজারের মতো। ফলে দেখা যাচ্ছে, প্রায় ৫৩ শতাংশ কারখানা কমবেশি বিপাকে পড়বে। উল্লেখ্য, বিজিএমইএর সদস্যদের বাইরেও দেশে রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা রয়েছে।

বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান গতকাল রোববার প্রথম আলো আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে বলেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে শুল্কহার যদি ভিয়েতনাম, ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বেশি হয়, তাহলে তা রপ্তানি খাতের জন্য ভালো হবে না।

প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকের শিরোনাম ছিল, ‘যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক: কোন পথে বাংলাদেশ’। রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজিত এ বৈঠকে দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও গবেষকেরা অংশ নেন।

গোলটেবিল বৈঠকে কারখানার ওপর প্রভাব পড়ার হিসাবটি তুলে ধরেন মাহমুদ হাসান খান। তিনি জানান, বিজিএমইএর সদস্য ১০০টি কারখানা তাদের মোট রপ্তানির ৯১ থেকে ১০০ শতাংশ করে যুক্তরাষ্ট্রে। ৫০০টি কারখানা তাদের মোট রপ্তানির ২০ শতাংশের বেশি করে যুক্তরাষ্ট্রে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত ২ এপ্রিল বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৬০টি দেশের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে শুল্কহার ধরা হয়েছিল তৎকালীন হারের অতিরিক্ত ৩৭ শতাংশ। পাঁচ দিনের মাথায় ৭ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রকে দুটি চিঠি পাঠায় বাংলাদেশ।

ট্রাম্প প্রশাসন অবশ্য ৯ এপ্রিল ন্যূনতম ১০ শতাংশ শুল্ক বজায় রেখে সব দেশের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ তিন মাসের জন্য স্থগিত করে। এই সময়সীমা শেষ হয় ৯ জুলাই। এর আগের দিন ৮ জুলাই ট্রাম্প নতুন করে ঘোষণা দিয়ে জানান, বাংলাদেশের জন্য পাল্টা শুল্কহার হবে ৩৫ শতাংশ, যা আগামী ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হওয়ার কথা। অর্থাৎ বাংলাদেশের হাতে এখন সময় আছে মাত্র ১০ দিন।

সরকার বিষয়টি নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করছে। কিন্তু প্রথম আলোর গোলটেবিলে ব্যবসায়ীরা দর–কষাকষির সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন। তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি কমে গেলে দেশে বেকার শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে পণ্য রপ্তানি করে আসছিল বাংলাদেশ। নতুন হার কার্যকর হলে তখন মোট শুল্কহার দাঁড়াবে ৫০ শতাংশ। ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে এই হার ২০ শতাংশ হবে বলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ঘোষণা এসেছে। দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় অনেকটাই এগিয়ে গেছে। ভারতের ক্ষেত্রে হারটি অনেকটা কম হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। যদিও ঘোষণা আসেনি।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে, সদ্য বিদায়ী ২০২৪–২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে ৮৭৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৪ শতাংশ বেশি। প্রথম আলোর অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ীরা জানান, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ভোক্তার খরচ করার প্রবণতা বাড়ছে, যা পণ্যের চাহিদা চাঙা রাখতে ভূমিকা রেখেছে। অন্যদিকে ইউরোপের বাজারে চাহিদার গতি অনেকটা মন্থর। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার বাদ দিয়ে অন্য বাজারে রপ্তানি বাড়ানো বাংলাদেশের জন্য কঠিন হবে।

অনন্ত গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) চেয়ারম্যান শরীফ জহির বলেন, পাল্টা শুল্ক না কমলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারনির্ভর পোশাক কারখানা ছয় মাসের বেশি টিকতে পারবে না। ফলে ১০ লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থানে প্রভাব পড়ার আশঙ্কা আছে।

বিশ্বে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশ তৃতীয় স্থানে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রথম চীন, দ্বিতীয় ভিয়েতনাম। বাংলাদেশের পরে রয়েছে ভারত ও ইন্দোনেশিয়া।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাবে, বিদায়ী অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট পণ্য রপ্তানির ১৭ শতাংশের গন্তব্য ছিল যুক্তরাষ্ট্র। এই বাজারে রপ্তানি হওয়া বাংলাদেশি পণ্যের ৮৭ শতাংশই তৈরি পোশাক। তবে দেশটির বাজারে বাংলাদেশে তৈরি জুতা ও সমজাতীয় পণ্য, ওষুধ ইত্যাদি রপ্তানি হয়।

প্রথম আলোর গোলটেবিলে অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, ‘মাঝে মাঝে আমি খুব ব্যথিত হই, যখন আমাদের বলা হয় নতুন বাজার খুঁজে বের করুন। কিন্তু আমরা কীভাবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভোক্তাপণ্যের বাজার ছেড়ে রাতারাতি নতুন বাজার পাব? এটা সম্ভব নয়।’