আগামী বাজেটে টোল, ফি, জরিমানা ও হাট ইজারার মূল্য বাড়ছে

আগামী অর্থবছরে কর ব্যতীত প্রাপ্তি থেকে সরকার চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৫ হাজার কোটি টাকা বেশি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরতে পারে।

আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে জেলা, উপজেলা, এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ের হাটবাজারের ইজারামূল্য কিছুটা বাড়বে। সেই সঙ্গে বাড়বে জমির নামজারির মাশুলও (ফি)। মোবাইল কোর্টসহ যেসব খাতে সরকার জরিমানা ও দণ্ড আরোপ করে, সেগুলোর পরিমাণও বাড়ানোর চিন্তা করছে সরকার।

এ ছাড়া উড়ালসড়ক, এক্সপ্রেসওয়েসহ বিভিন্ন সেতু পারাপারের টোল, সেবা ও প্রশাসনিক মাশুল এগুলোও বাড়ানো হতে পারে। এভাবে সরকার মোট ৫৫ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে চায়, যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৫ হাজার কোটি টাকা বেশি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ৬ জুন জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী যে বাজেট উপস্থাপন করবেন, তাতে এনটিআর থেকে এ পরিমাণ অর্থ আদায়ের কথা বলা হবে। তবে মাশুল বৃদ্ধির কোনো কথা অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্যে উল্লেখ করা হবে না।

সরকারের রাজস্ব আয়ের প্রধান তিনটি উৎস হচ্ছে আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) ও শুল্ক। এ উৎসগুলো থেকে আয় সংগ্রহের দায়িত্ব জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর)। এর বাইরেও অন্যতম একটি খাত রয়েছে সরকারের রাজস্ব আয় সংগ্রহের, যেটাকে সরকার বলে, কর ব্যতীত প্রাপ্তি (নন-ট্যাক্স রেভিনিউ)। সংক্ষেপে তা এনটিআর নামে পরিচিত।

নিজস্ব প্রয়োজন তো আছেই, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দিক থেকেও বাজেটে রাজস্ব বৃদ্ধির চাপ আছে। বাংলাদেশে বর্তমানে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় রাজস্ব সংগ্রহের হার ৮ শতাংশের কম। ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ কর্মসূচি অনুমোদনের সময় আইএমএফ বলে দিয়েছিল, বাংলাদেশকে রাজস্ব-জিডিপির হার বছরে দশমিক ৫ শতাংশ হারে বাড়াতে হবে। এনটিআরের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করার সময় অর্থ বিভাগ সেটিও বিবেচনায় রেখেছে বলে জানা গেছে।

সূত্রগুলো জানায়, মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলো প্রজ্ঞাপন জারি করে এসব মাশুল বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেবে। যেসব মাশুলে সরকার কয়েক বছর ধরে হাত দেয়নি, সেগুলোর ব্যাপারেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে আগে। কোনো কোনো মাশুল কার্যকর হবে আগামী ১ জুলাই থেকেই। কোনোটি আবার প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা তারিখ অনুযায়ী কার্যকর হবে।

সাবেক অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এনটিআরের বেশ কিছু জায়গায় মাশুল বৃদ্ধির সুযোগ আছে এবং মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় তা বাড়ানো উচিতও। উদাহরণ দিয়ে বলি, ভুল জায়গায় গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য ২০০ টাকা জরিমানার বিধান থাকলে তা বাড়িয়ে ৫ হাজার টাকা করতে হবে। এতে সরকারের আয় বাড়বে, শৃঙ্খলাও ফিরে আসবে।’

সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের রেশন মাশুলও বাড়ানোর পক্ষে মাহবুব আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমি যখন অর্থসচিব ছিলাম, তখন রেশনের দর কিছুটা বাড়ানো হয়েছিল। তবে খুব বেশি বাড়ানো ঠিক হবে না। বেশি বাড়ালে বাহিনীর সদস্যরা যে বাড়তি সুবিধাটা পাচ্ছেন, তা আবার থাকে না।’

মন্ত্রণালয়গুলো চায় বেশি, দেয় কম

অর্থ বিভাগের সূত্রগুলো জানায়, এনটিআর থেকে ভালো রাজস্ব সংগ্রহ নিয়ে অর্থ বিভাগ কয়েক বছর ধরে কাজ করলেও ভালো ফল পাচ্ছে না। এ ব্যাপারে সংস্থাগুলোর যেমন অসহযোগিতা আছে, মন্ত্রণালয়গুলো তেমন তৎপর নয়। মন্ত্রণালয়গুলো শুধু অর্থ নিতে চায়, অর্থ সংগ্রহের ব্যাপারে তাদের আগ্রহ কম।

সূত্রমতে, চলতি ২০২৩–২৪ অর্থবছরের মূল বাজেটে এনটিআর থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। এর আগের ২০২২–২৩ অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৫ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের মূল বাজেট থেকে ৫৫ হাজার কোটি টাকা ধরা হলেও শেষ পর্যন্ত বাড়িয়ে তা ৬০ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছিও করা হতে পারে। যদিও চার অর্থবছর আগেই এনটিআর থেকে ৫৮ হাজার ৮৬২ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে সরকার।

বিভিন্ন টোল ও মাশুল বৃদ্ধির অংশ হিসেবে গত ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের সঙ্গে আলোচনা করেছে অর্থ বিভাগ। দপ্তরগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই), প্রধান আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় (সিসিআইই), বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি), নৌপরিবহন অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর, যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর ইত্যাদি।

মাশুল বাড়াতে অধিদপ্তর ও পরিদপ্তরগুলোকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হয়। অর্থ বিভাগ সূত্র জানায়, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে জানানো হয়েছে, তারা যেন এনটিআর বৃদ্ধির প্রস্তুতি নেয়। এ জন্য উল্লেখযোগ্য মন্ত্রণালয়গুলো হচ্ছে বাণিজ্য, ভূমি, প্রাণিসম্পদ, রেলপথ, বেসামরিক বিমান ও পর্যটন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ইত্যাদি। জানা গেছে, কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও দপ্তর এরই মধ্যে কিছু দাম বাড়িয়েছে। যেমন ওয়াসা সম্প্রতি পানির দাম বাড়িয়েছে। কোনো কোনো দপ্তরেরও মাশুল বৃদ্ধির প্রস্তাব প্রক্রিয়াধীন।

বিভিন্ন বাহিনীর জন্য বহু বছর ধরে রেশনসহ কিছু পণ্যের দর বাড়ানো হচ্ছে না। অর্থ বিভাগের সূত্রগুলো জানায়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও এর অধীন সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী এবং আন্তঃবাহিনী দপ্তর এ বিষয়ে অর্থ বিভাগকে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে।

এনটিআরের প্রধান উৎসগুলো

এনটিআরের মধ্যে বড় ১০টি উৎস রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে লভ্যাংশ ও মুনাফা। ব্যাংক ও বিমাসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের বিপরীতে সরকার লভ্যাংশ ও মুনাফা পায়। এভাবে চলতি অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা হলো ৯ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা পাওয়া। অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরে এ লক্ষ্যমাত্রা একটু বাড়িয়ে ১০ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি হতে পারে। এ ছাড়া আগামী অর্থবছরে সুদ বাবদ প্রাপ্তি ধরা হচ্ছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। সরকার, সরকারি কর্মচারী, বিভিন্ন আর্থিক ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া ঋণের বিপরীতে সুদ পাওয়া যায়। প্রশাসনিক মাশুল বাবদ ধরা হচ্ছে ৬ হাজার কোটি টাকা।

আইন ও নিয়মনীতির পরিপন্থী বিভিন্ন কাজের জন্য সরকার জরিমানা, দণ্ড ও বাজেয়াপ্তকরণ করে প্রতিবছর কিছু অর্থ আয় করে থাকে। আগামী অর্থবছরে এ খাতে আয় ধরা হচ্ছে এক হাজার কোটি টাকা।

সরকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জনগণকে দেওয়া সেবার বিপরীতে আয় করে। যেমন আমদানি-রপ্তানি সনদের মাশুল, কোম্পানি নিবন্ধন মাশুল, বিমা প্রিমিয়াম, সমবায় সমিতিগুলোর নিরীক্ষা মাশুল, নিবন্ধন ও নবায়ন মাশুল ইত্যাদি। এসব সেবার বিপরীতে সরকার আগামী অর্থবছরে ৯ হাজার কোটি টাকা আয় নির্ধারণ করতে পারে।

হাট-ঘাটভাড়া ও ইজারা দিয়ে সরকার আগামী অর্থবছরে হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি আয় করতে চায়। টোল ও লেভি থেকে আসতে পারে আরও হাজার কোটি টাকার বেশি। সঙ্গে সঙ্গে আছে মূলধন রাজস্ব। পুরোনো গাড়ি বা আসবাবপত্র নিলামে বিক্রির অর্থ মূলধন রাজস্ব হিসেবে বিবেচিত হয়। আগামী অর্থবছরে এ খাতে আয় ধরা হচ্ছে ১০০ কোটি টাকার বেশি।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, দেশে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) কমছে এবং বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির একই জায়গায় আটকে আছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রবৃদ্ধি না হলে এনটিআর থেকে বেশি অর্থ সংগ্রহের সুযোগ কমে যায়। তাই সরকারের উচিত হবে এনটিআরের বদলে বরং এনবিআর নিয়ন্ত্রিত কর সংগ্রহে বেশি মনোযোগ দেওয়া। অর্থাৎ আগে করের আওতা বাড়ানো জরুরি। যাঁরা কর দেওয়ার মতো সক্ষম কিন্তু এখনো করের বাইরে আছেন, তাঁদের কাছ থেকে তা আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে।