জ্বালানি ও খাদ্য এক বছর আগের দামে ফিরেছে

এফএওর পূর্বাভাস, চলতি বছর বৈশ্বিক গম উৎপাদন এই যুদ্ধবিগ্রহের মধ্যেও শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্বজুড়ে তেল ও খাদ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করে। টানা কয়েক মাস এসব পণ্যের দাম অনেকটাই বাড়তি ছিল। তবে সুখবর হচ্ছে, বিশ্ববাজারে এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এখন অনেকটাই কমে এসেছে। বিশেষ করে জ্বালানি তেল ও খাদ্যের দাম যুদ্ধ-পূর্বাবস্থায় ফিরে গেছে।

জ্বালানির দামের ওপর অনেক ধরনের পণ্যের দাম নির্ভর করে। সে জন্য জ্বালানির দর মানুষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাস্তবতা হচ্ছে, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণেই মূলত চলতি বছর বিশ্বের দেশে দেশে রেকর্ড মূল্যস্ফীতি হয়েছে। আবার সেই মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তার জেরে চাহিদা কমতে শুরু করে এবং একপর্যায়ে জ্বালানির দামও কমতে শুরু করে। গত ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরুর পর একপর্যায়ে অপরিশোধিত জ্বালানির দর ব্যারেলপ্রতি ১২৭ ডলারে উঠে যায়। আর গতকাল সন্ধ্যায় এই প্রতিবেদন লেখার সময় অপরিশোধিত জ্বালানির বৈশ্বিক মানদণ্ড ব্রেন্ট ক্রুডের দর ছিল ব্যারেলপ্রতি ছিল ৭৬ দশমিক ১০ ডলার। ২০২১ সালের ১৩ ডিসেম্বর এই ব্রেন্ট ক্রুডের দর ছিল ৭৪ দশমিক ৩৯ ডলার। অর্থাৎ জ্বালানি তেলের দাম এক বছর আগের পর্যায়ে ফিরেছে।

একই সঙ্গে কমছে খাদ্যপণ্যের দাম। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার (এফএও) খাদ্য মূল্যসূচক এখন ঠিক এক বছর আগের অবস্থানে ফিরেছে। গত এক বছরে দেশের বাজারে খাদ্যপণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে গমের দাম। এফএওর তথ্যানুসারে, গত নভেম্বর মাসে বিশ্ববাজারে গমের দাম কমেছে ২ দশমিক ৮ শতাংশ। মূলত কৃষ্ণসাগরভিত্তিক শস্য সংগ্রহবিষয়ক উদ্যোগে রুশ ফেডারেশনের আবারও যোগ দেওয়ার কারণে গমের দাম কমেছে। ফলে ভবিষ্যতে তারা যদি এই উদ্যোগ থেকে বেরিয়ে না যায়, তাহলে গমের দাম তেমন একটা বৃদ্ধির সম্ভাবনা নেই।

* গত বছরের ডিসেম্বর মাসে এক মেট্রিক টন রাশিয়া-ইউক্রেনের গমের দাম ছিল ৩৩৬ ডলার, চলতি বছরের ২৫ নভেম্বর তা কমে দাঁড়ায় ৩২০ (রাশিয়া) ও ৩১৫ (ইউক্রেন) ডলার * আগামী বছরও তাপমাত্রা বেশি থাকবে। এতে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে।

নভেম্বর মাসে বিশ্ববাজারে চিনির দাম কিছুটা বেড়েছে। এ বছর চিনি উৎপাদনকারী দেশগুলোতে উৎপাদন বিলম্ব হওয়া, চাহিদা বৃদ্ধি ও ভারতের চিনি রপ্তানি হ্রাসের ঘোষণার কারণে চিনির দাম গত মাসে ৫ দশমিক ২ শতাংশ বেড়েছে।

সামগ্রিকভাবে নভেম্বর মাসে এফএওর খাদ্য মূল্যসূচক গত বছরের নভেম্বর মাসের কাছাকাছি বা সমান হওয়া সত্ত্বেও সব পণ্যের দাম যে গত বছরের নভেম্বর মাসের পর্যায়ে ফিরে গেছে, তা নয়। যেমন মাংস, দুগ্ধজাত খাবার, দানাদার খাদ্যের দাম গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এ বছরের নভেম্বর মাসে বাড়তি, কমেছে ভোজ্যতেল ও চিনির দাম—এই দুই পণ্যের দাম এতটা কমেছে যে সব মিলিয়ে খাদ্য মূল্যসূচক গত বছরের অবস্থায় ফেরত গেছে।

গমের দাম কমেছে

ইউক্রেনের সমতল উর্বর মাটি চাষের জন্য আদর্শ। যুদ্ধের আগে আন্তর্জাতিক বাজারে যত খাদ্য বেচাকেনা হতো, তার ৬ শতাংশ ইউক্রেন একাই উৎপাদন করত। অন্যদিকে রাশিয়া বিশ্বের বৃহত্তম গম রপ্তানিকারক। ইউক্রেন বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম শস্য রপ্তানিকারক, যারা সাধারণত বিশ্বের ৪২ শতাংশ সূর্যমুখী তেল, ১৬ শতাংশ ভুট্টা ও ৯ শতাংশ গম উৎপাদন করে থাকে। আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বলছে, আফ্রিকায় ৪০ শতাংশের বেশি গম সরবরাহ করে ইউক্রেন ও রাশিয়া।

এই যখন বাস্তবতা, তখন এই দুটি দেশ যখন যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তখন বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তা স্বাভাবিকভাবেই হুমকির মুখে পড়েছে। তবে এই নিরাপত্তাহীনতার মূল কারণ সরবরাহজনিত। এফএওর পূর্বাভাস, চলতি বছর বৈশ্বিক গম উৎপাদন এই যুদ্ধবিগ্রহের মধ্যেও শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। এ বছর গম উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ৭৮১ দশমিক ১ মিলিয়ন টন। তবে ধানের উৎপাদন ২ দশমিক ৪ শতাংশ কমতে পারে বলে পূর্বাভাস।

এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের মূল্য এক বছর আগের তুলনায় উল্টা কমে এসেছে। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে এক মেট্রিক টন রাশিয়া-ইউক্রেনের গমের দাম যেখানে ছিল ৩৩৬ ডলার, চলতি বছরের ২৫ নভেম্বর তা কমে দাঁড়ায় ৩২০ (রাশিয়া) ও ৩১৫ (ইউক্রেন) ডলার।

অনিশ্চয়তা আছে

এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, আগামী কয়েক প্রান্তিকে খাদ্যের দাম আবারও বৃদ্ধি পাবে—এমন ঝুঁকি আছে। কারণ হিসেবে তারা বলছে, আগামী বছরও প্রকৃতিতে আবহাওয়ার (লা নিনার) প্রভাব থাকবে, অর্থাৎ তাপমাত্রা বেশি থাকবে। এতে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে। সেই সঙ্গে যুদ্ধ চলছেই, রাশিয়া যদি আবারও কৃষ্ণসাগর দিয়ে পণ্য চলাচলের চুক্তি থেকে সরে আসে, তাহলে গমের দাম আবারও বাড়বে। গ্যাস স্বল্পতার কারণে সারের দাম বাড়তি। সে কারণেও খাদ্যমূল্য বাড়তে পারে।

বিশ্ববাজারে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম কমতির দিকে। সেই সঙ্গে শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামালের দামও কমছে। কিন্তু ডলারের বিনিময় মূল্য বাড়তি থাকার কারণে বাংলাদেশের মতো আমদানিকারক দেশগুলো এই মূল্য হ্রাসের তেমন সুবিধা পাচ্ছে না। তবে সরবরাহ ব্যবস্থায় যে জটিলতা ছিল, তা অনেকটাই কমেছে। দেশে দেশে মন্দাভাব ও ডলারের বাড়তি দরের কারণে আমদানি কমছে, অর্থাৎ চাহিদা কমছে। সে জন্য বিশ্লেষকদের ধারণা, পণ্যের দাম আপাতত আর বৃদ্ধির সম্ভাবনা কম। শুধু খাদ্যের দাম নিয়ে কিছু ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে।

সার্বিকভাবে আগামী বছর বিশ্ব অর্থনীতির অবস্থা ভালো যাবে না বলেই বিশ্লেষকেরা পূর্বাভাস দিচ্ছেন। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশগুলো মন্দার কবলে পড়ছে বলে আশঙ্কা। ইতিমধ্যে সেখানে চাহিদা কমতে শুরু করেছে। এতে জ্বালানি তেলের দাম খুব একটা বাড়বে না বরেই ধারণা করা হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি ও ডলারের বিনিময় হার দেশে দমে কমে আসবে বলেও বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।