দেশের উত্তরাঞ্চলে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার হার অন্য এলাকাগুলোর তুলনায় বেশি। সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তাহীনতার মুখে আছে রাজশাহী বিভাগের মানুষ। এ বিভাগের প্রায় ৩২ দশমিক ৯০ শতাংশ পরিবার মাঝারি বা মারাত্মক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার শিকার।
একই চিত্র ময়মনসিংহ ও রংপুর বিভাগে। অর্থাৎ এই তিন বিভাগে প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন মাঝারি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় আছে। অথচ এই তিন বিভাগ হলো দেশে ধান, সবজি ও মাছ উৎপাদনের অন্যতম কেন্দ্র। এর মধ্যে দেশের সর্বোচ্চ পরিমাণ মাছ উৎপাদন হয় ময়মনসিংহে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, খাদ্য উৎপাদনের কেন্দ্রগুলোতেই নিরাপত্তাহীনতা বেশি হওয়ার মূল কারণ হলো, উৎপাদন মাথাপিছু সহজলভ্য না হওয়া এবং খাদ্যপণ্যের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া।
বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) ও কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, ‘উৎপাদিত কৃষিপণ্য কতটা সহজলভ্য, সেটি একটি বিষয়। আর সহজলভ্য হলেও খাদ্যপণ্যের ক্রয়ক্ষমতা কতটা আছে, সেটাও আরেকটি বিবেচ্য।’ তাঁর মতে, উভয় কারণেই উৎপাদন এলাকায় খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হতে পারে। মূল্যস্ফীতির কারণে দাম বাড়লে কৃষকের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। তাই উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি দাম স্বাভাবিক রাখার পরামর্শ দেন তিনি।
** ধান, মাছ ও সবজি উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্রেই মাঝারি থেকে গুরুতর নিরাপত্তাহীনতা বেশি। ** গ্রামে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ২৫.৭৫%, শহরে ২০.৯৪%; সিটি এলাকায় মাত্র ৭.৮৬%। ** রাজশাহীতে ৩২.৯০%, ময়মনসিংহে ৩২.৬২%, রংপুরে ৩০.৫৮%, সিলেটে ২৮.২৬%, ঢাকায় ১৭.৫০% ও চট্টগ্রামে ১৩.৩২% এবং সিটি করপোরেশন এলাকায় ৭.৮৬% মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীন।
সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খাদ্য নিরাপত্তা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ময়মনসিংহ বিভাগে উচ্চ মাত্রার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা রয়েছে। এখানে প্রায় ৩২ দশমিক ৬২ শতাংশ পরিবার মাঝারি বা মারাত্মকভাবে খাদ্য নিরাপত্তাহীন। এর মধ্যে ৩১ দশমিক ৭৩ শতাংশ মাঝারি এবং শূন্য দশমিক ৮৯ শতাংশ মারাত্মক খাদ্য নিরাপত্তাহীন অবস্থায়।
বিবিএসের কৃষি উৎপাদনের হিসাব বলছে, গত ২০২২–২৩ অর্থবছরে দেশে মোট আমন ধান উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ৫৪ লাখ ২৬ হাজার ৩৯৫ টন। সেবার রংপুরে সর্বোচ্চ ৩১ লাখ ৬৪ হাজার টন ধান উৎপাদন হয়েছে। ২৩ লাখ ৯৫ হাজার টন আমনের উৎপাদন নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে রাজশাহী। ময়মনসিংহে উৎপাদন হয় ১৫ লাখ ৭১ হাজার টন। ধান ছাড়াও মাছ, আলু, পেঁয়াজসহ বিভিন্ন সবজির বড় জোগান আসে এই তিন অঞ্চল থেকে।
মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২৩–২৪ অর্থবছরে দেশে পুকুরে চাষ থেকে মোট মাছ উৎপাদিত হয়েছে ২৩ লাখ ৬৮ হাজার ৭৪১ টন। এর মধ্যে শুধু ময়মনসিংহ বিভাগে ৫ লাখ ৭৫ হাজার ১৭৫ টন উৎপাদিত হয়। এই অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ উৎস পুকুর, নদী, খাল–বিল মিলিয়ে এ বিভাগে মোট মাছ উৎপাদন হয় ৭ লাখ ২৪ হাজার টন, যা দেশে সর্বোচ্চ।
রংপুর বিভাগের পরিস্থিতিও উদ্বেগজনক। এখানে মাঝারি থেকে গুরুতর খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় থাকা পরিবারের হার ৩০ দশমিক ৫৮ শতাংশ। সিলেট বিভাগে ২৮ দশমিক ২৬ শতাংশ পরিবার মাঝারি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় আছে।
অন্যদিকে ঢাকা বিভাগে মাঝারি থেকে গুরুতর খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার হার ১৭ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং চট্টগ্রামে এই হার আরও কম—১৩ দশমিক ৩২ শতাংশ।
মাঝারি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় থাকা পরিবারগুলো খাবারের মান ও পরিমাণে ঘাটতির মুখে পড়ে। তারা যথেষ্ট খাদ্য পায় না, পছন্দসই খাবার বেছে নিতে পারে না, কখনো খাবারের মান কমাতে হয়, কখনো কম খেতে হয়—এমনকি খাবার নিয়ে অনিশ্চয়তাও থাকে।
গ্রাম–শহর তুলনা করলে দেখা যায়, গ্রামে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বেশি। গ্রামীণ এলাকায় ২৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ পরিবার মাঝারি থেকে গুরুতর খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। শহরে এই হার ২০ দশমিক ৯৪ শতাংশ।
বিবিএসের এ–সংক্রান্ত প্রতিবেদন তৈরির ফোকাল পারসন হলেন সংস্থাটির কৃষি শাখার উপপরিচালক মেহেনাজ তাবাসসুম। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রশ্নমালা অনুযায়ী তথ্য সংগ্রহ করেছি। কোন এলাকায় খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বেশি—এর কারণ জানতে আরও বিশ্লেষণ দরকার। হয়তো এসব এলাকার মানুষের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়।’
২৯ হাজার ৭৬০টি খানা থেকে ২০২৩ সালের খাদ্য নিরাপত্তা পরিসংখ্যানের তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনটি তৈরি করে বিবিএস।
সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত এলাকায় খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতি দেশের মধ্যে সবচেয়ে ভালো। এ ধরনের এলাকায় মাঝারি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় থাকা পরিবারের হার মাত্র ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ, আর গুরুতর নিরাপত্তাহীন পরিবার ১ শতাংশের কম।