তেল, চিনির ঋণপত্র কমে গেছে

আমদানি ঋণপত্র খোলা কমার সঙ্গে কয়েকটি পণ্যের ঋণপত্র নিষ্পত্তিও কমেছে। এর প্রভাবে কমছে কিছু নিত্যপণ্যের আমদানিও।

ডলার–সংকটে আমদানি ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে সমস্যার কারণে ছয় পণ্যের আমদানি কমে গেছে। এর মধ্যে কয়েকটি নিত্যপণ্যও রয়েছে। যেসব পণ্যের আমদানি ঋণপত্র খোলা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে, সেগুলো হলো অপরিশোধিত চিনি, অপরিশোধিত সয়াবিন তেল, সয়াবিনবীজ, অপরিশোধিত পাম তেল, ছোলা ও খেজুর। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমেছে অপরিশোধিত পাম তেল ও সয়াবিনবীজ আমদানির ঋণপত্র।

অথচ নিত্যপণ্যের আমদানির ঋণপত্র খোলা স্বাভাবিক রাখতে গত কয়েক মাসে দফায় দফায় পরিপত্র জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তা সত্ত্বেও নিত্যপণ্যের আমদানির ঋণপত্র খোলা কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের শেষ প্রান্তিকে (অক্টোবর–ডিসেম্বর) অপরিশোধিত চিনির ঋণপত্র খোলার পরিমাণ আগের বছরের চেয়ে ২৮ শতাংশ কমেছে। এ ছাড়া অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের ৪৭ শতাংশ, সয়াবিন বীজ ৮৩ শতাংশ, অপরিশোধিত পাম তেল ৯৯ শতাংশ, ছোলা ৪৭ শতাংশ ও খেজুর আমদানির ঋণপত্র খোলা কমেছে ৩০ শতাংশ।

আমদানি ঋণপত্র খোলা কমে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে দেশে পণ্যের সংকট দেখা দেওয়া। ইতিমধ্যে বাজারে কিছু কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে সেই প্রভাব দেখা যাচ্ছে। কয়েক মাস ধরে বাজারে চিনির সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। আমদানিকারকেরা বলছেন, ডলার–সংকটের কারণে তাঁরা সময়মতো আমদানি ঋণপত্র খুলতে পারছেন না। এ কারণে সরকারের পক্ষ থেকে কয়েক দফায় চিনির দাম বাড়ানোর পরও বাজারে নির্ধারিত দামে চিনি মিলছে না। এমনকি প্যাকেটজাত চিনি বাজার থেকে উধাও হয়ে গেছে।

নিত্যপণ্য বিপণনকারী কোম্পানি টিকে গ্রুপের পরিচালক মো. শফিউল আতহার তাসলিম প্রথম আলোকে বলেন, ঋণপত্র খোলার পর সেই পণ্য আমদানি হতে দুই মাস সময় লাগে। তবে জাহাজের সংকট দেখা দিলে তাতে তিন মাসের বেশি সময় লাগে।
জানতে চাইলে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) জ্যেষ্ঠ মহাব্যবস্থাপক এস এম মুজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক নিত্যপণ্যের ঋণপত্র খুলতে বারবার তাগিদ দেওয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। বর্তমানে ঋণপত্র খোলা একেবারে বন্ধ নেই, তবে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বর্তমানে ৫০ শতাংশের মতো ঋণপত্র খোলা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আরও গতি আনা দরকার। আমাদের দিক থেকে চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই। ব্যাংকগুলোর আরও এগিয়ে আসা উচিত।’

এদিকে আমদানি ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ছেন ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা। ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে দর-কষাকষিতে বড় আমদানিকারক ও শিল্প গ্রুপগুলো যতটা এগিয়ে থাকে, ততটাই পিছিয়ে থাকেন ছোট ও মাঝারি পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা। যেভাবে ঋণপত্র খোলা কমছে, তা অব্যাহত থাকলে আসন্ন রমজানে চাহিদার তুলনায় কিছু পণ্যের আমদানি কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। বিশেষ করে ফল ও খেজুর আমদানির ক্ষেত্রে এ প্রভাব বেশি পড়তে পারে।

ঢাকা মহানগর ফল আমদানি-রপ্তানিকারক ও আড়তদার ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক শেখ আবদুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদেশি ফল আমদানিতে গতি নেই। শুধু খেজুরের ক্ষেত্রে কিছু আমদানি ঋণপত্র খুলতে পারছেন ব্যবসায়ীরা। তবে সেটা অন্যবারের তুলনায় কম। ব্যাংকে ঋণপত্র খুলতে গেলে তাঁরা বলছেন ডলার–সংকটের কথা। তাই রমজানে এবার অন্য বছরের তুলনায় খেজুর আমদানি ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কম হতে পারে।’

আসন্ন রমজান সামনে রেখে গত ডিসেম্বরে ব্যবসায়ীদের কম টাকা জমা দিয়ে আট পণ্যের আমদানির ঋণপত্র খোলার নির্দেশ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপরও ঋণপত্র খুলতে হিমশিম খাওয়ার কথা বলছেন আমদানিকারকেরা।

গত কয়েক মাসে নিত্যপণ্য আমদানির জন্য কেমন ঋণপত্র খোলা হয়েছে, তা জানতে চাইলে এ–সংক্রান্ত তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক। তিনি বলেন, ‘এসব তথ্য দেওয়া যাবে না। এতে বাজারে সংবেদনশীলতা দেখা দিতে পারে। ঋণপত্র বেশি খুললে দাম কমবে, কম খুললে দাম বাড়বে।’

পবিত্র রমজান সামনে রেখে বাজারে যাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সংকট দেখা না দেয়, সে জন্য আমদানি স্বাভাবিক রাখার ওপর জোর দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ জন্য মন্ত্রণালয়ের দ্রব্যমূল্য ও বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা–সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সর্বশেষ বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়। সভায় রমজানের অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুত ও আমদানির তথ্য নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, পণ্য আমদানি ও মজুতের যে অবস্থা, তাতে বাজারে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। বিগত বছরগুলোর অভিজ্ঞতায় ভোজ্যতেল, চিনি, মসুর ডাল, ছোলা, পেঁয়াজ, খেজুর, চাল-গমের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশে উঠে এসেছে, চলমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে আমদানিনির্ভর পণ্যগুলো আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা হচ্ছে। অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের মধ্যে চিনির ঋণপত্র তুলনামূলক কম। তাই নিত্যপণ্যের ঋণপত্র খোলার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

এদিকে ঋণপত্র খোলার পরিমাণ কমে যাওয়ার পাশাপাশি অপরিশোধিত চিনি ও পাম তেল এবং ছোলা ও খেজুরের ঋণপত্র নিষ্পত্তির হারও কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুলাই–ডিসেম্বর সময়ে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে অপরিশোধিত চিনি আমদানি কমেছে দুই লাখ টনের বেশি। আর অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি কমেছে এক লাখ টনের বেশি।

ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাজারে নিত্যপণ্যের যাতে কোনো সংকট তৈরি না হয়, সে জন্য সরকারকে নিয়মিতভাবে ঋণপত্র খোলা ও সরবরাহব্যবস্থা তদারকি করতে হবে।’