শর্ষের চাহিদা বাড়ায় তিন বছরে উৎপাদন বেড়ে দ্বিগুণ

  • শুধু ব্র্যান্ডগুলোর শর্ষের তেলের বাজার প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার।

  • বড় সরবরাহকারী এসিআই, প্রাণ, সিটি, স্কয়ার, ফ্রেশ ও ওরিয়ন গ্রুপ।

শর্ষে খেতফাইল ছবি: প্রথম আলো

রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার চন্দ্রিমা হাউজিংয়ে এক বছর আগে ‘পাবনা চাষি ওয়েল মিল’ নামে শর্ষের তেল বিক্রির একটি দোকান খোলেন সুজন আলী। দোকানেই বসানো মেশিনে শর্ষে ভাঙান এবং তেল বিক্রি করেন। এর আগে ২০১৬ সাল থেকে রাস্তায় রাস্তায় তেল বিক্রি করতেন এ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। তিনি জানান, চাহিদা থাকায় এখন রাস্তার মোড়ে মোড়ে শর্ষের তেল বিক্রি হয়। তাই দোকান দিয়েছেন। দৈনিক ৫০ লিটারের বেশি তেল বিক্রি হয়। নিয়মিত গ্রাহকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় এ এলাকায় এখন প্রায় ১০টি তেল ভাঙানোর মেশিন চালু হয়েছে।

এদিকে তেলের চাহিদা ও বিক্রি বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশে শর্ষের উৎপাদন বাড়ছে। মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে উৎপাদন বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। যদিও চতুর্থ বছরে কমেছে এবং পঞ্চম বছরে এবার আবার বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে শর্ষের উৎপাদন ছিল ৮ লাখ ২৪ হাজার মেট্রিক টন। এরপর ২০২২-২৩ অর্থবছরে উৎপাদন বেড়ে ১১ লাখ ৬৩ হাজার টন এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে একলাফে ১৬ লাখ টন ছাড়িয়ে যায়। যদিও তিন বছরে উৎপাদন দ্বিগুণ হওয়ার পর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বৃষ্টির কারণে উৎপাদন কমে ১৫ লাখ টনে নেমে যায়। তবে চলতি অর্থবছরে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭ লাখ টন।

দোকানের পাশাপাশি এখন রাজধানীর বিভিন্ন অলিগলি ও রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে মেশিনে শর্ষে ভাঙিয়ে তেল বিক্রি করতে দেখা যায়। এ রকম একজন বিক্রেতা হলেন নাটোর থেকে আসা খালেক মিয়া, যিনি মোহাম্মদপুরের রেসিডেনসিয়াল স্কুলের সামনে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত, দুপুর থেকে বিকেলে শিয়া মসজিদ এলাকায় এবং সন্ধ্যা ও রাতে নিউমার্কেট এলাকায় তেল বিক্রি করেন। খালেক মিয়া জানান, প্রতিদিন তিনটি স্থানে তাঁর প্রায় ১৫০ লিটার তেল বিক্রি হয়। এ ছাড়া কেরানীগঞ্জে তাঁর একটি নিজস্ব অয়েল মিল রয়েছে। সেখানে পাইকারি ও খুচরায় তেল বিক্রি হয়।

বলা হয়ে থাকে, অন্যান্য তেলের তুলনায় শর্ষের তেল বেশি স্বাস্থ্যসম্মত এবং এর পুষ্টি উপাদান ভালো। সে অনুযায়ী মানুষের মধ্যে দিন দিন সচেতনতা বাড়ছে। ফলে শর্ষের তেলের বিক্রি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিক্রেতারা মৌসুমে শর্ষের দানা কিনে রাখেন। এরপর সারা বছর ভাঙিয়ে তেল বিক্রি করে থাকেন।

খাতসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, শর্ষে উৎপাদন বৃদ্ধিতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ‘তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি’ প্রকল্প একটি বড় ভূমিকা রাখছে। প্রকল্পটির মাধ্যমে দেশের ২৫০টি উপজেলায় তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করা হচ্ছে। তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বৃদ্ধির জন্য এ প্রকল্প নেওয়া হয়।

এ বিষয়ে উপপ্রকল্প পরিচালক মো.আবদুল্লাহ আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমন ও বোরো মৌসুমে ধান চাষের মধ্যবর্তী সময়ে কৃষিজমি পতিত থাকে। এমন পতিত জমিতে কৃষকদের শর্ষে চাষে উদ্বুদ্ধ করতে আমরা বীজ, সার ও কীটনাশক সরবরাহ করি, যাতে কৃষকেরা শর্ষে চাষে আগ্রহী হন।’

দুই ফসলের মাঝের ৮০ থেকে ৮৫ দিন সময়ে শর্ষের ফলন উঠে যায়। প্রকল্পটির মাধ্যমে শর্ষের আবাদ ৭ লাখ হেক্টর থেকে ১১ লাখ হেক্টরে উন্নীত হয়েছে। তবে দেশে আরও প্রায় ১০ লাখ হেক্টর কৃষিজমি দুই ফসলের মাঝের সময়ে পতিত থাকে বলে জানান উপপ্রকল্প পরিচালক। এসব জমিতে শর্ষের আবাদ করে দেশে তেল উৎপাদন আরও বাড়ানো যায়।

বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, করোনার পর থেকে দেশে শর্ষের তেলের চাহিদা ও বিক্রি বাড়ছে। ১ লিটার তেল তৈরিতে প্রায় তিন কেজি শর্ষে দানার প্রয়োজন হয়। ১ কেজি দানা থেকে সাড়ে ৩০০ গ্রাম তেল আর সাড়ে ৬০০ গ্রাম খৈল পাওয়া যায়। আর এসব খৈল বিক্রি করা যায় ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজিতে। এক কেজি শর্ষে দানার দাম প্রায় ১০০ টাকা পড়ে।

বর্তমানে স্থানীয় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ভাঙানো শর্ষের তেলে ২৪০ থেকে ২৮০ টাকা লিটার দরে বিক্রি হয়। আর ৫ লিটারের বোতল পাওয়া যায় ১ হাজার ১৫০ টাকায়। হাফ লিটার তেলের দাম পড়ে ১৩০ থেকে ১৫০ টাকা। যদিও বোতলজাত ব্র্যান্ডের তেলের দাম আরও বেশি, প্রতি লিটার ৩০০ থেকে ৩৪০ টাকা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে সবচেয়ে বেশি শর্ষের আবাদ হয় সিরাজগঞ্জ জেলায়। তারপরই রয়েছে টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, পাবনা ও বগুড়া জেলা। কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, এখন ময়মনসিংহের ত্রিশালে বিল এলাকায় নতুন করে শর্ষে চাষ করা হচ্ছে। এসব জমি আগে পতিত থাকত। এ ছাড়া নতুন করে ঢাকার পার্শ্ববর্তী ধামরাইয়েও শর্ষের চাষাবাদ বাড়ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি দপ্তরের (ইউএসডিএ) তথ্যমতে, বাংলাদেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৩২ লাখ টন। আর মাথাপিছু ভোজ্যতেল গ্রহণের হার বছরে ১৭ কেজি। এ চাহিদার ৫০ শতাংশ পাম তেলে পূরণ হয়। দামে সস্তা হওয়ায় দেশে এই তেল বেশি ব্যবহৃত হয়। ২৮ শতাংশ চাহিদা পূরণ হয় সয়াবিন তেলে। শর্ষের তেলে পূরণ হয় ১৯ শতাংশ তেলের চাহিদা। বাকি ৩ শতাংশ বিভিন্ন তেলের মাধ্যমে পূরণ হয়ে থাকে।

দেশে ভোজ্যতেলের বাজার নিয়ে ইউএসডিএর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে রেস্তোরাঁ বাড়তে থাকায় তেলের চাহিদা বাড়ছে প্রতিনিয়ত। বিশেষ করে শর্ষের তেলের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। এবার আলুর দাম না পাওয়ায় অনেক কৃষক শর্ষে উৎপাদনে ঝুঁকবেন বলেও ধারণা সংস্থাটির। শর্ষে থেকে উৎপাদিত কাসুন্দিরও জনপ্রিয়তা বাড়ছে বলে ইউএসডিএর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

দেশে বোতলজাত বা ব্র্যান্ডের শর্ষের তেলের বাজারে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে এসিআই, প্রাণ, সিটি, স্কয়ার, ফ্রেশ ও ওরিয়ন গ্রুপ। এসব প্রতিষ্ঠান স্থানীয় শর্ষের পাশাপাশি আমদানি করা শর্ষে থেকে তেল তৈরি করে। দেশ থেকে অল্প পরিমাণ শর্ষের তেল বাহরাইন, সৌদি আরব, কাতার ও মালয়েশিয়ায় রপ্তানি হয়।

প্রাণের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় শর্ষের তেল রপ্তানি করে থাকি। মূলত প্রবাসী বাংলাদেশিরা এই তেল কিনে থাকেন। তা ছাড়া সেখানে অবস্থানরত ভারত, পাকিস্তান ও এশিয়ান দেশগুলোর লোকজনও কেনেন।’

এ খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে ব্র্যান্ডের শর্ষে তেলের বাজার এখন এক হাজার কোটি টাকার ওপরে। প্রতিবছর সার্বিকভাবে ৫ থেকে ৬ শতাংশ হারে শর্ষের তেলের বাজার বাড়ছে। তবে শর্ষের তেলের ব্যবসায় গত এক বছরে এসিআইর ২৮ শতাংশ ও প্রাণের ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে বলে প্রতিষ্ঠান দুটির কর্মকর্তারা জানান।

জানতে চাইলে এসিআই কনজ্যুমার বিজনেসের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘মানুষ সচেতন হচ্ছে। ফলে শর্ষে তেলের চাহিদা বাড়ছে। তাই এসিআই পিউরের সঙ্গে আমরা নতুন ব্র্যান্ড “অ্যারোমা” নিয়ে এসেছি। মানুষের স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে আমরা শর্ষে ও রাইস ব্র্যান তেলের বিক্রি আরও বাড়াতে চাই। এসব তেলের বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় ধরন নিয়ে আসতে চাই আমরা।’

স্থানীয়ভাবে প্রথাগত পদ্ধতিতে তেল প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রক্রিয়াকরণের পার্থক্য সম্পর্কে জানতে চাইলে মোহাম্মদ রেজাউল ইসলাম জানান, ‘উভয় ধরনের প্রক্রিয়ায় মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। তবে প্রথাগত পদ্ধতিতে খুব পুরোনো যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়। সেখানে তেল পুরোপুরি পরিশোধিত হয় না। তাই এটাকে খুব বেশি স্বাস্থ্যসম্মত বলা যায় না। আমরা নিষ্কাশন করে তেল পরিশোধন করি। এতে তেলের উপাদানগুলো অক্ষুণ্ন থাকে।’