সংকটে কর আদায় বাড়াতে উদ্যোগ

অর্থনীতিতে এই চাপের সময়ে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে শুল্ক-কর আদায়ের পরিমাণ বাড়াতে চায় এনবিআর।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রধান কার্যালয়
ছবি: সংগৃহীত

অর্থনীতিতে এই চাপের সময়ে দেশের অভ্যন্তরীণ খাত থেকে শুল্ক-কর আদায়ের পরিমাণ বাড়াতে চায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ জন্য সংস্থাটি সাত দফা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এমন এক সময় এ পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে যখন আইএমএফ থেকে বড় ধরনের ঋণ চেয়ে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ। তাই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে আইএমএফের ঋণ পাওয়ার উদ্যোগের অংশ হিসেবে আগাম এ পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে কীনা। কারণ দীর্ঘদিন ধরেই আইএমএফ রাজস্ব খাতের সংস্কারের পরামর্শ দিয়ে আসছে।

এনবিআর যেসব পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সেগুলো হলো—উৎসে কর কর্তনের অনলাইন ব্যবস্থা সর্বস্তরে প্রচলন; অনলাইনে কর প্রদানে সব ক্ষেত্রে ‘এ-চালান’ চালু; ডিজিটাল আয়কর নিরীক্ষার ব্যবস্থা প্রবর্তন; অনলাইনে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট রিটার্ন শতভাগ অনলাইনে দাখিল; কর ও ভ্যাট আহরণের ভিত্তি সম্প্রসারণ; কর্মকর্তাদের কর আহরণে দক্ষতা বৃদ্ধি এবং কর দেওয়ার পদ্ধতি সহজ করে তোলা ও স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু করা।

সম্প্রতি এনবিআর এই পরিকল্পনা ঠিক করেছে। অবশ্য কিছু দিন আগে এনবিআর কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) একটি প্রতিনিধিদল রাজস্ব আদায় বাড়াতে একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা তৈরির পরামর্শ দিয়েছে। আইএমএফসহ দাতা সংস্থাগুলো দীর্ঘদিন ধরেই রাজস্ব খাত সংস্কারের কথা বলে আসছে। শিগগিরই আইএমএফের সঙ্গে সাড়ে চার শ কোটি ডলারের ঋণ নিয়ে আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু হতে যাচ্ছে।

করের ভিত্তি সম্প্রসারণ ছাড়া রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করা মুশকিল। এ জন্য এনবিআরকে একটি বিস্তারিত পরিকল্পনা নিতে হবে। সময় ধরে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। সাড়ে ১৬ কোটি জনসংখ্যার দেশে মাত্র ২৫ লাখের মতো মানুষ কর দেন।
সৈয়দ আমিনুল করিম, এনবিআরের সাবেক সদস্য

গত তিন দশকে একমাত্র ভ্যাট আইন ছাড়া আর কোনো বড় সংস্কার হয়নি। সীমিত পরিসরে কিছু অটোমেশন তথা স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু হয়েছে। কিন্তু তা পর্যাপ্ত পরিমাণে রাজস্ব আহরণে যথেষ্ট নয়। তবে আগামী তিন বছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক-কর আদায়ের লক্ষ্য ৬৬ শতাংশের বেশি বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে। সর্বশেষ ২০২১–২২ অর্থবছরে ৩ লাখ ১৭৯ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করেছে এনবিআর। অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এনবিআরের জন্য ৫ লাখ ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

জানতে চাইলে এনবিআরের সাবেক সদস্য সৈয়দ আমিনুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, করের ভিত্তি সম্প্রসারণ ছাড়া রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করা মুশকিল। এ জন্য এনবিআরকে একটি বিস্তারিত পরিকল্পনা নিতে হবে। সময় ধরে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। সাড়ে ১৬ কোটি জনসংখ্যার দেশে মাত্র ২৫ লাখের মতো মানুষ কর দেন। দেশের গ্রাম-গঞ্জে অনেক অর্থনৈতিক ‘গ্রোথ সেন্টার’ গড়ে উঠেছে। সেখানে কর দেওয়ার মতো সামর্থ্যবান লোক আছেন। তাঁদের কাছ থেকে কর আদায় করতে হবে।

স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় জোর বেশি

কর বিভাগ প্রতিবছর যত কর আদায় করে থাকে, এর ৮৬ শতাংশ উৎসে কিংবা অগ্রিম কর। ঠিকাদারি, আমদানি পর্যায় ও সঞ্চয়পত্রের সুদের হার থেকে উৎসে অগ্রিম কর হিসেবে আসে প্রায় ২৩ শতাংশ। উৎসে কর আদায়ের ব্যবস্থাটি পুরোপুরি অনলাইন করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। এ ধরনের কর স্বয়ংক্রিয়ভাবে কেটে তা সরকারি কোষাগারে জমা হওয়ার ব্যবস্থা চালু করার কথা ভাবছে এনবিআর।

বড় প্রতিষ্ঠানগুলো অনলাইনে সরকারি কোষাগারে কর পরিশোধের ক্ষেত্রে এ-চালান বাধ্যতামূলক করার কথাও ভাবছে সরকার। এখন এ-চালানের জন্য একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত ছাড় আছে।

ঘরে বসে যাতে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতারা আয়কর রিটার্ন দিতে পারেন, সে জন্য একটি অনলাইন ব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে। এটি অনেকটা অ্যাপের মতো হবে। নিবন্ধন নিয়ে ওই ওয়েবসাইটে ঢুকে ঘরে বসেই রিটার্ন জমা দেবেন করদাতা। এমনকি আয়-ব্যয়সংক্রান্ত কিছু তথ্য দিলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে রিটার্নও তৈরি করে দেবে কর বিভাগের ওই সিস্টেম। চলতি বছরেই এটি বিস্তৃতভাবে চালু হচ্ছে বলে জানা গেছে। গত বছর এই ব্যবস্থা সীমিত পরিসরে চালু করা হয়।

তখন বেশ সাড়া পাওয়া যায়। গতবার ৬১ হাজার ২০৬ জন করদাতা ই-রিটার্ন দিয়েছেন। তাঁরা কর কার্যালয়ে না গিয়ে ঘরে বসেই রিটার্ন দেন। আবার ৭৯ হাজার ৭৪৫ জন করদাতা রিটার্ন জমা না দিলেও রিটার্ন প্রস্তুত করেছেন। আবার কোম্পানির ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন জমায় এখন অনলাইনে আর্থিক প্রতিবেদন যাচাই–বাছাইয়ের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে।

এনবিআরের কর্মকর্তারা জানান, আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে এনবিআর পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় যেতে পারবে।

ভ্যাটের রিটার্ন শতভাগ অনলাইনে

বর্তমানে দেশে সাড়ে তিন লাখ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান আছে। এর মধ্যে প্রায় আড়াই লাখ বা ৭০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান প্রতিমাসে অনলাইনে ভ্যাট রিটার্ন দেয়। চলতি অর্থবছরেই এটি শতভাগে উন্নীত করতে চায় এনবিআর। ইতিমধ্যে বিভিন্ন ভ্যাট কমিশনারেটকে অনলাইনে ভ্যাট রিটার্ন জমার বিষয়ে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানকে সচেতন করার তাগিদ দিয়েছে ভ্যাট বিভাগ। অনলাইনে ভ্যাট রিটার্ন নিশ্চিত করা গেলে হয়রানি কমে যাবে, সহজে ভ্যাট রিটার্ন দিতে পারবেন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা। তখন ভ্যাট আদায়েও গতি আসবে।

করের ভিত্তি সম্প্রসারণ

ভ্যাট ও করের ভিত্তি সম্প্রসারণে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে এনবিআর।বর্তমানে ১০০ উপজেলায় কর অফিস আছে।দেশের সব উপজেলায় কর অফিস চালুর জন্য নতুন জনবল দরকার।এনবিআরের নতুন জনবল কাঠামো অনুমোদনের বিষয়টি এখন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আছে।শিগগিরই নতুন জনবল মিলবে বলে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আশা করেন।