বাজেটে নারীর হিস্যা নিয়ে ধোঁয়াশা

নারীর উন্নয়নে চলতি অর্থবছরের বাজেটেই প্রথম আড়াই লাখ কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ করা হয়।

নারীর অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি কম। অথচ বাজেটের এক-তৃতীয়াংশ অর্থ নারীর উন্নয়নে খরচ হয়। গত এক যুগে নারীর উন্নয়নে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। সরকার বাজেটের মাধ্যমে চলতি ২০২৩–২৪ অর্থবছরেও আড়াই লাখ কোটি টাকার বেশি খরচ করছে, যা জেন্ডার বাজেট হিসেবে পরিচিত।

কিন্তু বিপুল পরিমাণ এই অর্থের পুরোটাই নারীর উন্নয়নে খরচ হচ্ছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এ নিয়ে ধোঁয়াশা আছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদেরা।

চলতি অর্থবছরে জেন্ডার বাজেটের আকার ২ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা। ৪৪টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এই টাকা খরচ করছে। নারীর উন্নয়নে সরকারি ব্যয়ের পাশাপাশি অবশ্য বেসরকারি খাতও বিনিয়োগ করে থাকে।

বাজেটের এক-তৃতীয়াংশের বেশি টাকা নারীর উন্নয়নে খরচ হচ্ছে। কিন্তু কীভাবে এই টাকা খরচ হচ্ছে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা আছে। আবার এত খরচ করা হলো, উন্নতিটা কোথায় হলো, তা নিয়েও কোনো পর্যালোচনা করা হয় না।
ফাহমিদা খাতুন, নির্বাহী পরিচালক, সিপিডি

এ নিয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, নারীর উন্নয়নে ধীরগতি আছে, তা নিয়ে সংশয় নেই। বাজেটের এক-তৃতীয়াংশের বেশি টাকা নারীর উন্নয়নে খরচ হচ্ছে। কিন্তু কীভাবে এই টাকা খরচ হচ্ছে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা আছে। আবার এত খরচ করা হলো, উন্নতি কোথায় হলো, তা নিয়েও কোনো পর্যালোচনা করা হয় না। তিনি আরও বলেন, একটি বড় সেতু করা হলো, সেই সেতু নারী-পুরুষ সমানভাবে ব্যবহার করল। এখন ওই অবকাঠামো নির্মাণের অর্ধেক খরচ যদি জেন্ডার বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তাহলে কি সেটিকে নারীর উন্নয়ন বলা যাবে? নারীর উন্নয়ন করতে হলে লক্ষ্যভিত্তিক বরাদ্দ দিতে হবে।

যে ধরনের বরাদ্দ নিয়ে প্রশ্ন

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের জন্য চলতি অর্থবছরে উন্নয়ন ও পরিচালনা ব্যয়সহ ২ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে নারীর হিস্যা ১ হাজার ৩০১ কোটি টাকা বা ৫৪ শতাংশ।

এ বছরের জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদনে কিছু খাতের বরাদ্দকে নারীর উন্নয়ন হিসেবে দেখানো হয়েছে। যেমন দেশের ১১ কোটি ৯২ লাখ ভোটারের মধ্যে অর্ধেক নারী। তাঁদের ডেটাবেজ তৈরির পাশাপাশি পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে নারীর স্বকীয়তার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ এই ধরনের খরচকেও জেন্ডার বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ঢাকার মিরপুর ও মালিবাগে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ৭৪৪টি ফ্ল্যাট নির্মাণ করেছে। এসব ভবনে পুরুষের পাশাপাশি নারী কর্মকর্তাদেরও আবাসন সমস্যার সমাধান হয়েছে। তাই একে জেন্ডার বাজেটের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় দেশে গ্যাস উত্তোলন বাড়িয়েছে। আবার এলএনজি আমদানি বাড়িয়ে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছে। এসব খাতের বরাদ্দও জেন্ডার বাজেটে দেখানো হয়েছে। কারণ, গৃহস্থালির কাজে গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় নারীর স্বস্তি বেড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদনে।

নারীর জন্য বাজেটে কত বরাদ্দ

গত দেড় দশকের চিত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, টাকার অঙ্কে নারীর উন্নয়নে বা জেন্ডার বাজেট প্রায় ১০ গুণ বেড়েছে। এখন মোট বাজেটের এক-তৃতীয়াংশ খরচ হয় নারীর উন্নয়নে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৪ বছর আগে অর্থাৎ ২০০৯-১০ অর্থবছরে সব মিলিয়ে নারীর জন্য বাজেট ছিল মাত্র ২৭ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা। তখন বাজেটের ২৫ শতাংশের মতো অর্থ নারীর উন্নয়নে খরচ হত। এরপর প্রতিবছরই নারীর জন্য বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে। তাতে নারীর আনুপাতিক হিস্যাও বেড়েছে। সর্বশেষ চলতি অর্থবছরে তা প্রথমবারের মতো আড়াই লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

চলতি ২০২৩–২৪ অর্থবছরের বাজেটের আকার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে নারীর উন্নয়নে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা, যা বাজেটের ৩৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ।

সরকার মূলত ৪৪টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মাধ্যমে জেন্ডার সম্পৃক্ত বাজেট বা নারীর উন্নয়নে খরচ করে থাকে। মোটাদাগে তিন বৃহৎ খাতে এই অর্থ খরচ করা হয়। এই খাতগুলো হলো নারীর ক্ষমতায়ন ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি; উৎপাদন, শ্রমবাজার ও আয়বর্ধক কাজে নারীর অধিক অংশগ্রহণ; সরকারি সেবা প্রাপ্তিতে নারীর সুযোগ বৃদ্ধি। জেন্ডার সম্পৃক্ত বাজেটে উন্নয়ন ও পরিচালন ব্যয় দুই খাতে বরাদ্দ থাকে। পরিচালন ব্যয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ আনুষঙ্গিক খরচ অন্তর্ভুক্ত আছে।

১৪টির মধ্যে ২টি প্রকল্প অর্থনৈতিক উন্নয়নে

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় নারীর উন্নয়নে কাজ করার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি সংস্থা। চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বই ঘেঁটে দেখা গেছে, এই মন্ত্রণালয়ে ১৪টি প্রকল্প চলমান। এসব প্রকল্পে প্রায় ৪ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। প্রকল্পগুলোর মধ্যে মাত্র দুটি নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত।

এই প্রকল্প দুটি হলো ২৭৭ কোটি টাকার উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং ৪২৮ কোটি টাকার নারীর অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রকল্প। সব মিলিয়ে নারীর অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত উন্নয়ন প্রকল্পের খরচ এই মন্ত্রণালয়ের মোট উন্নয়ন খরচের মাত্র ১৬ শতাংশ। এই মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পগুলোর মধ্যে ভবন ও হোস্টেল নির্মাণ, কিশোর-কিশোরী ক্লাব, শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র, সাঁতার সুবিধা প্রদানের মতো প্রকল্পও আছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হক প্রথম আলোকে বলেন, নারীর উন্নয়ন কিছুটা ধীরগতিতে আছে। সুবিধাভোগী নারীর সংখ্যা যেমন কম, তেমনি সেবার মানও পর্যাপ্ত নয়। নারীর উন্নয়নের জায়গা অস্থির অবস্থায় আছে। নারীর উন্নয়নের ক্ষেত্রে যেসব বাধা রয়েছে সেগুলো দূর করতে হবে। এ জন্য নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ তৈরি করতে হবে। নারীর স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচলের জন্য পরিবহনব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। অন্যদিকে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যাংকঋণসহ অর্থায়নের সুযোগ সহজ করা দরকার। উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য সময়োপযোগী প্রশিক্ষণ চাই।

তানিয়া হক আরও বলেন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ নারীর জন্য যেমন চ্যালেঞ্জিং, তেমনি সুযোগও উন্মুক্ত। এই সুযোগগুলো ধরতে হবে।